তবু ভালোবাসা খুঁজি

মিষ্টি মণ্ডল (কান্দি, মুর্শিদাবাদ)

    কনীনিকার বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই।তার স্বামী সংকল্পের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী বোঝাপড়া।বছর পঁচিশ আগে তারা যখন সংসার শুরু করেছিল তখন তাদের ঘরে বিদ্যুত ছিলনা,মাথার ওপর পাকা ঢালাই দেওয়া ছাদ ছিলনা।মাটির দেওয়ালের এককামরা ঘর আর মাথার উপর খড়ের চাল।সেই খড়ের চালে যখন পূর্ণিমার রাতে চাঁদ মোলায়েম চোখ বুলিয়ে দিত তখন সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ত আঙিনায়।খড়ের চালের ঝলকানিতে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠত সারাবাড়ি।আসলে সুখ একটা উপলব্ধির নাম।শুধু তাকে খুঁজে নিতে হয়,বুঝে নিতে হয়।এই পঁচিশ বছরে কনীনিকা ও সংকল্পের সংসার জীবনে কখনও মতাদর্শের পার্থক্য আসেনি এমনটা নয়,তবে তারা উভয়েই নিজেদের ত্রুটিগুলোর অবস্থান্তর করতে করতে কাঁধ ছুঁয়ে সুখী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করে চলেছে।

  আজ সংকল্প-কনীনিকার বিবাহবার্ষিকী, এবছর তাদের বিবাহিত জীবনের রজত জয়ন্তী।গোধূলি পেরোলেই সন্ধ্যা আর সন্ধ্যায় সংকল্প অফিস থেকে ফেরে।কনীনিকা আনমনে বসে চিন্তা করছে তার স্বামী আর দুই বছর পরেই চাকুরী জীবনে অবসরগ্রহন করবেন।আর তারপর সারাটা বেলা সময় কাটাতে একঘেয়েমি আসবেনা তো!নাহ্ নাহ্ বরং ভালো হবে।বিশ্রাম দরকার।একটু একটু করে আজ কুটির থেকে দালান হয়েছে।একমাত্র কন্যা শ্রুতি আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে,সরকারী হাসপাতালের সেবিকা।এখন আর বিবাহবার্ষিকী নিয়ে বিশেষ কোনো আয়োজন করতে সাধ হয়না কনীনিকার।দীর্ঘ সংসার জীবনের প্রতিটি দিনই তাদের পরিণত।এখন চিন্তা হয় শুধু অবিবাহিতা সুশীলা কন্যাটিকে নিয়ে।চারপাশের নির্মম সমাজ যেন তাদের লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে।প্রতিষ্ঠিত মেয়েটি তার ডিউটিতে গেলে বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত কপালে চিন্তার ভাঁজ থাকে কনীনিকার।সংকল্প সারাদিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকে।তবে কনীনিকার মন সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই অস্থির হয়ে ওঠে।যতদিন না পর্যন্ত মেয়েটির একটা সুযোগ্য পাত্রের হাতে সম্পাদন করতে পারে ততদিন শান্তি নেই কনীনিকার।

  এই সপ্তাহে শ্রুতির নাইট সিফট্ এর ডিউটি।বাড়ি ফিরতে সকাল সাড়ে সাতটা কি আটটা হয়।সংকল্প সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে মনে করে একটা কেক আর কাগজে মোড়ানো শুকনো খোলার বাদাম নিয়ে এসেছে।কনীনিকা খুব পছন্দ করে শুকনো খোলার বাদাম।সুখী সংসারে কনীনিকা,সংকল্প ও কন্যা শ্রুতি একটা খুশির সন্ধ্যা উদযাপন করল।জাঁকজমক না হলেও যেন শান্তির আবেশ।তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শ্রুতি ডিউটিতে বেরিয়ে গেল।সংকল্পের সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে অফিসে তাই বিশ্রাম দরকার।কনীনিকা ও সংকল্প শয়নে গেল।

  প্রত্যুষে শীঘ্রই কনীনিকার ঘুম ভেঙে যায় রোজ।পরদিন বাসি কাজ সেরে চা,ব্রেকফাস্ট বানাতে রান্নাঘরের উদ্দেশ্য রওনা দিল।সংকল্প ঘুম থেকে উঠে মর্নিং ওয়াকে যায়।সে ফিরে চা খেতে খেতেই শ্রুতি ফিরে আসার সময় হয়ে যায়।সাড়ে সাতটা থেকে আটটা বেজে সাড়ে আটটা হয় তবুও শ্রুতি বাড়ি ফেরেনি আজ।চিন্তায় কনীনিকা ফোন করলে শ্রুতির ফোন বেজে যায় বারবার কিন্তু ফোন রিসিভ করেনা শ্রুতি।বেলা যত গড়াতে থাকে উদ্বিগ্নতা তত বাড়তে থাকে কনীনিকার।সংকল্প অফিস যাওয়ার প্রস্তুতি বাদ দিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার পরিকল্পনা করে।তখন বেলা সাড়ে নয়টা।সংকল্প বেরোতে যাবে এমন সময় শ্রুতি বাড়ি ফিরে আসে।মা বাবার উদ্বিগ্নতা দেখে আঁতকে উঠে বলে কি ব্যাপার তোমরা এত টেনশন করছ কেন বলোতো?আসলে আমি ডিউটি শেষ করে বের হতে যাব এমন সময় আমাদেরই এক সহকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়ে।তাকে নিয়েই আমরা সবাই ব্যস্ত ছিলাম।আমারও তো সেখানে থাকা কর্তব্য তাই নয়কি বলো?আর আমার ফোন তো বেশিরভাগ সময়ই সাইলেন্ট থাকে তোমরা জানো।ফোন দেখার সময় হয়নি।অযথা চিন্তা করো তোমরা।কিচ্ছু হবেনা আমার।আই অ্যাম ইওর ব্রেভ গার্ল।ওকে!

  সব শোনার পর কনীনিকা ও সংকল্প স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।আসলে আমাদের সমাজটা অধিকাংশ কলুষিত হয়ে গেছে।আতঙ্ক ঘিরে থাকে বাবা মায়ের মন।টিভিতে,খবরে কত কিছু শোনা যায়।সহজ জিনিসকে আজকাল জটিল মনে হয়!মাথায় টেনশন নিয়েই এগিয়ে চলতে হচ্ছে।তবে এখনও মানবিকতা হারিয়ে যায়নি।কিছু জায়গা এখনও সুন্দর।গোলাপের সুবাস আসে।ভালোবাসার গন্ধে ম ম করে।এই যেমন কনীনিকা ও সংকল্পের সংসার!শ্রুতির কর্মস্থানে মনুষ্যত্ব!ভালোবাসা আছে...ঠিকই আছে..অনেকক্ষেত্রে আছে..সহমর্মিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।শুধু তাকে খুঁজে নিতে হবে,বুঝে নিতে হবে।
CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )