শিলিগুড়ি কলেজে সাড়ম্বরে পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস

শিলিগুড়ি কলেজে সাড়ম্বরে পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস

ভাস্কর চক্রবর্তী, শিলিগুড়ি:- গোটা দেশের পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে সাড়ম্বরে পালিত হল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ব্যতিক্রম নয় শিলিগুড়ি মহাবিদ্যালয়ও। প্রতিষ্ঠানের ৭৫ তম বর্ষকে সামনে রেখে, চলতি বছর শিলিগুড়ি কলেজ ৮ মার্চ – আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে এক অন্যরূপ, এক অন্য স্পর্ধার দিশারী হিসেবে তুলে ধরল। সেন্টার ফর ওমেন্স স্টাডিজের তত্ত্বাবধানে ও শিলিগুড়ি কলেজ এনএসএসের পৌরহিত্যে এদিন কলেজ অডিটরিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কলেজ প্রাঙ্গণে ফুড ফেস্টের আয়োজন করা হয়। এদিনের বর্ণাঢ্য আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ সুজিত ঘোষ, শিলিগুড়ি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রোফেসর ডঃ বিদ্যাবতী আগরওয়াল, সেন্টার ফর ওমেন্স স্টাডিজের কো-অর্ডিনেটর ডঃ ডালিয়া রায়, আইকিউএসি’য়ের কনভেনর তথা রসায়ন বিভাগের পক্ষে ডঃ ঝিনুক দাশগুপ্ত, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের পক্ষে অমল রায়, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ডঃ উর্বী মুখোপাধ্যায় সহ শিলিগুড়ি কলেজের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যাপিকা সহ বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীরা এদিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়াও ১৭ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা ৩ নং বোরো কমিটির চেয়ারপার্সন মিলি শীল সিনহা এদিন উপস্থিত থেকে ফুড ফেস্টের শুভ উদ্বোধন করেন। যেখানে বেলা ১টা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আগত সকল দর্শকদের জন্য বিভিন্ন ফুড স্টল খোলা রাখা হয়। উদ্বোধন পরবর্তী পর্যায়ে মিলি দেবী বলেন, “আসলে নারীদের অধিকার নারীরা নিজেরাই অর্জন করে নিয়েছে। এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। তবে যা প্রশংসার তা হল শিলিগুড়ি কলেজের এই খাদ্য মেলা। যা সম্পূর্ণ নারী দ্বারা পরিচালিত। এখানে ছোট ছোট ছাত্রীরা নিজ উদ্যোগে নানান খাওয়ার স্টল দিয়েছেন। এমনকি বিভিন্ন হস্তশিল্পেরও স্টল রয়েছে। যা একেবারেই অভিনব। আর নারী দিবসে এমন আয়োজন সত্যি বাহবার দাবী রাখে।”

এদিন শিলিগুড়ি কলেজের অধ্যক্ষ ডঃ সুজিত ঘোষ বলেন, “শিলিগুড়ি কলেজের ৭৫ তম বর্ষে পদার্পণ আর সেই সঙ্গে নারী দিবস এক যুগ্ম আনন্দ বার্তা বহন করছে। এদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছাত্রীদের দ্বারা খাদ্য মেলার আয়োজন করা হয় কলেজ প্রাঙ্গনে। যেখানে মোট ৪২টি ফুড স্টল ও ৩টি হস্তশিল্পের স্টলের ব্যবস্থা করা হয়। ছাত্রীরাই সমস্ত আয়োজন করেন। আমাদের কলেজের অধ্যাপিকারা গোটা বিষয়টির উপর নজরদারি করেন। আর তার ফলপ্রসূ আজকের এই আয়োজন। আজকের এই আয়োজন আমাদের ছাত্রীদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে ও স্বাবলম্বী হওয়ার বার্তা।”

অধ্যক্ষের সুরে সুর মিলিয়ে শিলিগুড়ি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর তথা এদিনের আয়োজনের তত্ত্বাবধায়িকা ডঃ বিদ্যাবতী আগারওয়াল বলেন, “শিলিগুড়ি কলেজের ৭৫ তম বর্ষপূর্তি চলছে বলেই এবার আমাদের মাথায় নারী দিবসকে কেন্দ্র করে একটু অন্যরকম চিন্তাভাবনা ঘুরছিল। আমাদের লক্ষ্য ছিল প্রত্যেকটি ছাত্র-ছাত্রীদের সদর্থক অংশগ্রহণ। তাই আমরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এই খাদ্য মেলার আয়োজন করি। যেখানে ছাত্রীরা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় ও নিজ উদ্যোগে ফুড স্টল দিয়েছেন। যা গোটা শিলিগুড়ি বাসীর জন্য খোলা।”

অন্যদিকে, সেন্টার ফর ওমেন্স স্টাডিজের কো-অর্ডিনেটর ডঃ ডালিয়া রায় বলেন, “এদিনের নারী দিবস ছিল একেবারেই আলাদা। আমাদের কলেজে ছাত্রীদের সদর্থক ভূমিকায় অডিটোরিয়ামের সাংস্কৃতিক আয়োজন পেয়েছিল এক অন্য মাত্রা। সেই সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন বিভাগের অধ্যাপিকারাও এদিনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। পাশাপাশি, আমাদের সেই ছাত্রীরাই আবার কলেজ প্রাঙ্গনে খাদ্য মেলার আয়োজন করে। সারাদিনব্যাপী অনুষ্ঠানে এদিনের নারী দিবস একেবারেই অন্যরকম ছিল।”

প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্ক শহরের একটি পোশাক কারখানায় নারী পোশাক শ্রমিকেরা ন্যায্য মজুরি ও শ্রমের দাবিতে আন্দোলন করেন। আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল পুুরুষের সমান মজুরি এবং দৈনিক ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি। এই আন্দোলনে পুলিশ নির্যাতন চালায় এবং অনেককে গ্রেপ্তার করে। এরপর ১৯০৮ সালের একই দিনে নিউইয়কে পোশাক শ্রমিক ইউনিয়নের নারীরা আরেকটি প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। ১৪ দিন ধরে এই প্রতিবাদ চলে এবং এতে প্রায় ২০ হাজার নারী শ্রমিক অংশগ্রহণ করেন। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রম এবং শিশুশ্রম বন্ধের দাবিতে তাঁরা এ আন্দোলন করেন। কর্মক্ষেত্রে এই আন্দোলন নারীদের ঐক্যবদ্ধতার একটি বড় উদাহরণ।

অতঃপর ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ক্লারা জেটকিন নারীর ভোটাধিকার এবং একটি নারী দিবস ঘোষণার দাবি জানান। ১৯১৩ সালে রাশিয়ায় নারীরা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ রোববার নারী দিবস হিসেবে পালন করেন। ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘ ৮ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়।

বলে রাখা ভালো, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদটি ‘সিডও’ নামে পরিচিত। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এটি গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালে ২০টি দেশ সমর্থন করার পর এটি কার্যকর হয়। বাংলাদেশসহ মোট ১৩২টি দেশ বর্তমানে সনদটি সমর্থন করেছে। এই সনদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো—এটি নারীর অধিকারের একটি পূর্ণাঙ্গ দলিল। এটি বিভিন্ন সময় নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনে গৃহীত বিভিন্ন ইস্যুকে সমন্বিত করে। এই সনদ নারীর প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বকে নিশ্চিত করে। সিডও সনদে ৩০টি ধারা আছে। প্রথম ১৬টি ধারা নারীর প্রতি কত প্রকার বৈষম্য আছে, তা বিশ্লেষণ করে। আর পরের ১৪টি ধারা ব্যাখ্যা করে এ বৈষম্যগুলো কীভাবে বিলোপ করা যায়। এছাড়াও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৫ নভেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ। জাতিসংঘ ৮ মার্চকে বিশ্ব নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )