মানুষ
নীহার চক্রবর্তী (বেথুয়াডহরি, নদীয়া)

মুজিব সপরিবারে দুর্গা-মণ্ডপে ঘুরে বেড়ায়। সেই সপ্তমী থেকে নবমী। মুজিবের বৌ আবার ঘাটে মার বিসর্জন দেখে কেঁদে ফেলে।
অনেকেই দেখে অবাক হয় । নানা প্রশ্ন ওঠে মনে। তবে এতদিন কেউ সাহস করে এগিয়ে গিয়ে ওকে কিছু বলেনি।
শেষপর্যন্ত আগ্রহী সনাতন মণ্ডল এগিয়ে এলো মুজিবের কাছে।
সে মুজিবকে অম্লান-বদনে বলল–
একটা কথা বলি। মনে কিছু কর না । তা তোমরা তো মুসলমান। তবু আমাদের দুর্গা ঠাকুর দেখতে যাও। কেমন একটা ব্যাপার না?
মুজিব শুনে অনাবিল হাসল।
পরে বলল–
চারদিকে আলোর ঝলকানি আর মানুষের কোলাহল। আমরা কি ঘরে বসে থাকতে পারি ? তাই আর কি। এতে আবার ধর্মের কথা আসে কেন ?
সনাতন শুনে কিছুসময় চুপ করে থাকলো।
তারপর স্মিত হেসে বলল মুজিবকে–
আর তোমার বৌ প্রতিমা-বিসর্জন দেখে কাঁদে যে।
মুজিব উত্তর দিলো মধুর-হেসে–
আমার বৌ তো এই বাংলার ঘরের মেয়ে। আগমনী আর বিজয়া ব্যাপারটা ও দিব্যি জানে। বোধহয় বাংলা পড়তে গিয়ে কলেজেও পড়েছে। আসলে ওর বাড়ির কথা মনে পড়ে যায়। দুর্গা তো আমাদেরই মেয়ে। তার সঙ্গে আমার বৌ নিজেকে মিলিয়ে দেখে।
তাহলে বুঝলাম এবার ব্যাপারটা। বেশ ভালো। বেশ ভালো। তোমাদের মতো মানুষের আজ খুবই অভাব। আমিও ভুল করি। বন্ধুদের ইদের নেমন্তন্নে যাই না। বাড়ি থেকে বৌ বারণ করে খুব। এবার আর শুনছি না। যাচ্ছিই এবার।
সনাতন পরম তৃপ্তির হাসি হেসে কথাগুলো বলল মুজিবকে।
মুজিব তার হাত ধরে বিনয়ের সুরে বলল–
আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকলো তবে। সে এখনো একমাস পরে। আবার বলবো কিন্তু। পারলে বাড়ি গিয়ে বলবো। কেমন ?
সনাতন কিন্তু মুজিবের কথার কোন উত্তর দিতে পারেনি। শুধু এক চিলতে হেসে মাথা নিচু করে নেয়।
শেষে সেই ইদের দিন এলো। তার দুদিন আগে মুজিব এলো তার বাড়িতে। সনাতন ‘যাবো’ বলেও ইদের দিন মুজিবের বাড়িতে গেলো না।
সনাতন ইদের দিন সারাবেলা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভাবল–
না পেলাম মার শিক্ষা। না দিলো বৌ শিক্ষা। সবাই কেমন যেন। ধর্মের কথা উঠলেই কেমন কুঁকড়ে যায়।
পরে মুজিবের সঙ্গে দেখা হলে সনাতন পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু মুজিব হাসতে হাসতে ছুটে গিয়ে তাকে ধরল।
দুটো হাত ধরে সহাস্যে বলল–
আমরা কিছু মনে করিনি, দাদা। এই হয়। এর কোন চেঞ্জ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে এবারো পুজোয় আমরা ঠাকুর দেখতে বেরবো। আসলে ধর্ম কিছু না। একটা দারুণ ঠেক। এর মজা নেবো না?
সনাতন অপরাধীর মতো হেসে একটি কথা না বলে নিজের পথ ধরল।
মুজিবের মুখ-জোড়া হাসিতে তখন যেন বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড অনবরত হেসে চলেছে।