বই শাপলার প্রেম

শিমুলতলা যেমন নাম তেমনি সৌন্দর্যে ভরা গ্রাম। সন্ধ্যা নামলে সন্ধ্যামালতীর রূপে জানাকিরা অন্ধকারে মিট মিট করে জ্বলে ওঠে পুকুর,নদীর পাড়ে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দে ওদের বংশবিস্তার হয় গ্রামের আনাচে কানাচে। আজ দুটো থেকে কাল চারটে, এভাবে চারটে থেকে চারশো। শহর থেকে বহু দূরে অবস্থিত এই শিমুলতলা গ্রাম। মাঝেমধ্যেই কলেজের ছেলেমেয়েরা এখানে আসে বন পিকনিক করতে। হ্যারিকেনের আলোয় খড়ের চালের ঘরে ওরা বাজায় গিটার। বনফায়ারের আগুনে ওরা বলে ওঠে "আগুনের পরশমণি   ছোঁয়াও প্রাণে। এ জীবন পুণ্য করো দহন-দানে"॥.....আবার কখন গেয়ে ওঠে, " তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম"।......রূপাই হা করে শোনে, "Every night in my dreams

I see you, I feel you
That is how I know you go on”….কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না।
নদীতে পরের দিন শাপলা,ঝিনুক তুলতে গিয়ে যখন দেখা হয় ফরিদের সাথে,তাকে জিজ্ঞাসা করে,’ওরা কি গাইছিলো রে….কি নাইট…ফিল কি সব বলছিলো’। ফরিদ হেসে বলে,’এই জন্যে তোকে বলি,আমার সাথে ওই জমিদারদের লাইব্রেরী তে চল। তা তো যাবি না’।……লাইব্রেরী সেটা আবার কি রে?…..’উফ্।…. আরো যেখানে অনেকে বই থাকে রে। কতো রকমের লেখালিখি। বই এর ভাঁজে কাগজের সাথে লেখকের প্রেমের গন্ধ’। ও সব তুই বুঝবি না। আচ্ছা আজ কি এনেছিস আমার জন্যে ? বল…..বল ?…..’ওই তো সরষে শাপলার ঝাল ঝাল তারকারি। আমি একটু খেয়েছি,বাকিটা তোর জন্যে এনেছি’।
একটু ফ্যানা ভাত ছিলো। ভাই দের দিয়ে দিয়েছে মা। ওরা পাঠশালায় যাবে কিনা। ওরাও তোর মতো বই পড়বে ওই লাইব্রেরি তে। দেখিস।

আজ মঙ্গলবার। নিজের জমানো ভাঁড় ভেঙ্গে টাকা দিয়েছে সে। ফরিদ শহরের উদ্দেশ্যে পা দিচ্ছে। পড়তে যাবে। ফিরলেই ফরিদ ওকে নিয়ে যাবে ওর বাড়ির লোকজনের সামনে। নদীর পাড়ে রূপাই তার ছোটবেলার বন্ধু কে হাসি মুখে বিদায় জানাচ্ছে। ফরিদ ফিরে এসে ওকে বোঝাবে বলেছে, “Every night in my dreams
I see you, I feel you
That is how I know you go on”…..এর অর্থ।
ততোদিনে একবার হলেও, ওর জায়গায় লাইব্রেরীর কার্ড দেখিয়ে, বই এর লেখালিখি গন্ধের সাথে মিশে থাকতে বলেছে ফরিদ।

রূপাই রোজ নদীতে শাপলা, ঝিনুক কোঁচরে করে তোলে। ফেরার পথে ধান খেতের পাশে মাটির রাস্তার দিকে তাকায়। ঘরে ফিরে পুরানো ক্যালেন্ডারের তারিখে দিন পার হয়ে যাওয়ার চিহ্ন আঁকে। ফের দিন শুরু হয়। নদীর চরের ধারে গাছপালা বুনো ফুলকে আলিঙ্গন করে চুম্বন করে। চোখের পাতা বন্ধ করে ডিঙ্গী নৌকায় কেশরাশি এলিয়ে নদী ও শিমুলের সাথে প্রেম করে। শীতল স্নিগ্ধ নৈসর্গিক আবহাওয়ায় ফরিদকে বার বার খুঁজে ফেরে,ক্লান্ত হয়ে ফের বাড়ি ফেরে ঝিনুক,শাপলা নিয়ে।

পরের দিন লাইব্রেরী তে গিয়ে রবীন্দ্রনাথঠাকুরের লেখা বইগুলো গুছিয়ে রাখবে বলে এসেছে সে। লাইব্রেরী গুছিয়ে দিলে পাঁচ টাকা দেবেন বলেছেন লাইব্রেরিয়ান। সরষে কিনবে সে তা দিয়ে। কালকের ভোরে ফরিদ আসবে শহর থেকে। সরষে শাপলা রাঁধবে রূপাই। নদীর ধারে ফের দুই বন্ধুর আত্মিক যোগসূত্র তৈরি হবে।
পরের দিন সকালে,ভাইদের খাইয়ে পাঠশালায় দিয়ে, খড়ের গাদা গুছিয়ে,ঘুঁটে গুলো রান্না ঘরে রেখে, কোঁচরে করে কৌটোয় বেঁধে নিল শাপলার চচ্চড়ি। বেশ ঝাল ঝাল করে রান্না করেছে সে। ফরিদ ঝাল খেতে ভালোবাসে। কিছুটা পথ চলতে চলতে মাথার উপরে মেঘের ঘনঘটা। প্রকৃতির কালো রূপ তেড়েফুড়ে আসছে বিরাট রন ডংকা বাজিয়ে। নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠচ্ছে। ওই তো ফরিদ মনে হচ্ছে। হ্যাঁ….হ্যাঁ ওটা ফরিদ। কিন্তু সাথে কে?……ফিরদ কারোর হাত ধরে ফিরচ্ছে ওই পথে।
রূপাই এর চোখের পাতায় আকাশ ফুঁড়ে পড়লো এক ফোঁটা জল। নিমিষের মধ্যে চারিদিকে প্রবল বারি বর্ষণ শুরু হতে লাগলো। নদীর বাঁধ ভেঙ্গে প্রবল জলরাশির স্রোত গ্রামের দিকে ঢুকতে লাগলো। ফরিদ তখন অন্য কারোর হাত শক্ত করে বাঁচার চেষ্টা করে চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। রূপাই নেই সেখানে তার চোখে মুখে বা অন্তরে।
প্রকৃতির তান্ডব লীলার শেষ ভোরের আলোতে, রূপাই কে পেলো কিছু গ্রামের লোকজনেরা ওদের ছোট নৌকায় লাইব্রেরীর বইগুলোকে আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকতে। ওর কোঁচরে তখন নদীর হাজারো শাপলা,ঝিনুক নিজে থেকেই এসে ধরা দিয়েছে। গ্রামের মাঝে টিকে থাকা কিছু ঘর বাড়ির মধ্যে টিকে আছে লাইব্রেরীর প্রধান ফটক সহ দু’একটি কক্ষ। ওর উঠোনে ভেসে রয়েছে সরষে শাপলার রান্না করা কৌটো।……রূপাই এর ভেজা চোখে মুখে, বিধ্বস্থ শরীরে সূর্যরশ্মির আলো এসে পড়তে লাগলো। কিন্তু তারপরে ;
কে জানে ? এই নব জন্মের পরে, হয়ে ছিলো কি বই শাপলার প্রেম ?

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )