২৯ঘন্টা পরে যোগদান পত্র পাওয়ার পর অবশেষে বিক্ষোভ শেষ হলো রামনগর কোলিয়ারিতে

২৯ঘন্টা পরে যোগদান পত্র পাওয়ার পর অবশেষে বিক্ষোভ শেষ হলো রামনগর কোলিয়ারিতে

কৌশিক মুখার্জী: কুলটি:-

রামনগর কোলিয়ারির জিএম অফিসের সামনে একটি মৃতদেহ নিঃশব্দে কথা বলছিল। স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেডের এই কয়লা খনির শ্রমিক কেদার পান(৪৮),গত রবিবার হাসপাতালের বিছানায় তিন মাসের জীবন-মৃত্যুর লড়াই থামিয়ে চিরনিদ্রায় চলে গেছেন। ফেব্রুয়ারির এক কালো দিনে খনির গভীরে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন তিনি। আঘাত এতটাই গভীর ছিল যে, তিন মাসের অপেক্ষা, হাসপাতালের শয্যা, আর পরিবারের প্রার্থনা কিছুই তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি। কিন্তু তাঁর চলে যাওয়া শুধু একটি পরিবারের শোক নয়, এটি ছিল শ্রমিকের জীবনের মূল্যহীনতা আর প্রশাসনের নির্মম নীরবতার এক নিষ্ঠুর সাক্ষ্য।সোমবার সকালে কেদার পানের পরিবার তাঁর মৃতদেহ নিয়ে জিএম অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছিল। তাঁদের হাতে কোনো প্ল্যাকার্ড ছিল না, কিন্তু চোখের জল আর কণ্ঠের আর্তনাদ ছিল তাঁদের অস্ত্র। তাঁরা শুধু একটি জিনিস চেয়েছিলেন কেদারের মেয়ে সুস্বেতার জন্য একটি চাকরি। এই দাবি ছিল না কেবল একটি অনুরোধ, এটি ছিল একটি পরিবারের বেঁচে থাকার শেষ আশা। সুস্বেতা, যিনি বাবার হাসিতে বড় হয়েছেন, তাঁর কাঁধে এখন মা, ভাইবোন, আর গোটা সংসারের দায়িত্ব। কিন্তু প্রশাসনের দরজা ছিল বন্ধ, তাঁদের কথা ছিল নিশ্চুপ। পরিবারের অভিযোগ, দুর্ঘটনার পর কোলিয়ারি কর্তৃপক্ষ কোনো সহায়তার হাত বাড়ায়নি। নিরাপত্তার অভাবই কেদারকে ছিনিয়ে নিয়েছে।তবু,এই শোকের মাঝে জন্ম নিয়েছিল এক অভূত পূর্ব ঐক্য। কেদারের মৃতদেহের সামনে জড়ো হয়েছিলেন স্থানীয় শ্রমিক, তাঁদের পরিবার, এমনকি বিজেপি, তৃণমূলের নেতারাও। ট্রেড ইউনিয়নের সদস্যরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রামনগর কোলিয়ারির ধূলিমাখা চত্বরে শোক আর ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল। স্থানীয়রা বলছেন, এই খনিতে দুর্ঘটনা নতুন কিছু নয়। শ্রমিকদের জীবন যেন মূল্যহীন। দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ বা সহায়তার কথা বললে কর্তৃপক্ষের মুখে তালা পড়ে যায়। কিন্তু এবার আর নয়। কেদারের মৃতদেহ যেন প্রতিটি শ্রমিকের মনে সাহস জাগিয়ে দিয়েছিল। দুই দিন ধরে বিক্ষোভ চলল। সুস্বেতার মা, ভাই, আত্মীয়, আর শ্রমিকরা অটল ছিলেন। তাঁদের চোখের জল আর কণ্ঠের চিৎকার অবশেষে প্রশাসনের নির্দয় দেয়াল ভেঙে দিল। কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করলেন। সুস্বেতাকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল। এটি ছিল একটি জয়। একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হল। সুস্বেতার মুখে হাসি ফুটল, কিন্তু সেই হাসি ছিল ম্লান। কারণ, এই জয়ের পিছনে ছিল তাঁর বাবার চিরবিদায়। দুই দিন পর, কেদার পানের শেষ যাত্রার প্রস্তুতি শুরু হল। চোখের জলে ভেজা সেই বিদায়ে শুধু পরিবার নয়, গোটা রামনগর কোলিয়ারি শোকে ডুবে গেল।কেদার পানের মৃত্যু একটি পরিবারের শোক নয়, এটি আমাদের সকলের জন্য একটি সতর্কবার্তা। রামনগর কোলিয়ারির এই গল্প শুধু শোক আর ক্ষোভের নয়, এটি ন্যায়ের জন্য একটি অটল লড়াইয়ের কাহিনি। কর্তৃপক্ষ বলেছেন, তদন্ত চলছে, পরিবারের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এই আশ্বাস কি যথেষ্ট? শ্রমিকদের জীবন কবে মূল্য পাবে? কবে প্রশাসন তাঁদের দায়িত্বের প্রতি সজাগ হবে? সুস্বেতার চাকরি একটি জয়, কিন্তু এই জয়ের মাঝে মিশে আছে একটি বাবার চলে যাওয়ার অসহনীয় বেদনা। কেদার পানের বিদায়ে শোকের সুর বাজলেও, তাঁর সংগ্রাম শ্রমিকদের মনে নতুন আলো জাগিয়েছে। এই গল্প শেষ নয়, এটি একটি নতুন শুরুর প্রতিশ্রুতি—ন্যায়, নিরাপত্তা, আর মানবিকতার জন্য।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )