স্টিয়ারিং
শম্পা মহান্তি (কলকাতা)

'পারিবারিক শিক্ষা কারোর পেটের ভাত দিতে না পারি ভাত কাড়বো না।'.....বিমলা কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের চাকরিটা ছেড়ে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে, নিজের অঞ্চলে নিজের মা বাবার কাছে থাকার জন্যে গ্রামের উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে জয়েন করলো।
আমি কর্মসূত্রে বিমলার খুব কাছের মানুষ। ওর বাচ্চা টা অ্যাবনরমাল। বছর পাঁচেক বয়স তার। স্বামী অন্য মহিলার প্রতি আসক্ত। কারণ বৌ তার স্বাভাবিক বাচ্চার জন্ম দিতে পারে নি। দিনরাত্রি ঘরে ওরকম ব্যাতিক্রমী বাচ্চা তার নাকি সহ্য হয় না। চাকরি টা ছিলো বলে আয়া মাসীর ভরসাতে ঘরে বাচ্চাকে রেখে যেতো স্কুলে। আর পাঁচটা বাচ্চার মতো যাতে স্বাভাবিক কিছু অভ্যাস তৈরি করানো যায় তার জন্যে শহরের একটি নামী প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যেতো কিছু বিশেষ ট্রেনিং এর জন্যে। খরচও প্রচুর হতো। প্রায় একাই লড়তো। ঘরে ফিরে একছাদের তলায় রাত কাটাতো এক চরিত্রহীনের সাথে আর দিনের শুরুতে স্কুলে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের থেকে কিছু অক্সিজেন নিয়ে ফিরতো ঘরে।
এভাবে বছর তিনেকের মধ্যে বিমলার স্বামী তাকে বিবাহ বিচ্ছেদের আইনি নোটিশ ধরায়। দিন রাত অশান্তি, নানাবিধ মানসিক যন্ত্রণা আর সহ্য হলো না তার। মনে হলো চাকরি তো আছে, তাহলে আর অমন অমানুষের সাথে থাকবে কেন। মালব্য উকিলকে বার বার ফোন করে,টাকা খাইয়ে বিবাহ বিচ্ছেদের বয়ানে Petitioner 1 এর জায়গাতে নাম রাখলো বিমলার। আর নিজের নাম রাখলো Petitioner no.2 তে। আর দিনরাত ব্যাতিব্যাস্ত করলো স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদে সই দিতে৷ ভাবলো বিমলা বুঝি কিছুই বোঝে না একেবারেই অবোধ।
এইভাবেই কোন একটা সকাল এলো, কোর্টে উভয়ের সম্পর্কের ইতি ঘটলো একটা সইতে। সেদিন বিমলার চোখের জলের সাক্ষী হয়তো ছিলো এই জগৎ সংসারের প্রকৃতি। মালব্য চেয়ে ছিলো বিমলার তরফে কেস সাজালে যাতে সহজে বিচ্ছেদ হয়।
না ; ওই শিশুটির জন্যে কোন খোরপোষ নেয়নি বিমলা। নেয় নি এযাবৎ কাল সে নিজে যা কিছুই করেছে শ্বশুরবাড়ীর জন্যে। শুধুমাত্র কেউ মুক্তি চেয়ে ছিলো তাকে মুক্তি দিয়ে ছিলো। নিজের আত্মসম্মানের জন্যে। নিজেকে একটু ভালো রাখে বাকি জীবনটা বাঁচার জন্যে।
আজকের সকালের পেপারে দেখলো ওর চাকরিটা আর নেই। তবে আগের কর্মক্ষেত্রে ফেরার কথা বলা হয়েছে।
বাচ্চাটা সবে আধো আধো শব্দে 'মাম....মা মামা মা' এমনটা বলা শিখেছে। পুরোপুরি মা বলাও শেখে নি। ওর আরো চিকিৎসা মুলক ট্রেনিং এর প্রয়োজন..... যা.... সময় সাপেক্ষ বিষয়।
হাউমাউ শব্দে তীব্র আর্তনাদ, 'ঈশ্বর আমি কারোর ক্ষতি করিনি। আমার কেন এমন হলো?'..... মালব্য কোনোরকম বাচ্চার দায়িত্বভার কোন দিনই পালন করে নি। খুব খারাপ সময়ে পাশেও থাকে নি তার। শুধুমাত্র নিজের স্ত্রীর বিরুদ্ধে কিছু গুটি সাজিয়ে তাকে কিভাবে নিজের জীবনের পরিধি থেকে ছেঁটে ফেলা যায় তাই পরিকল্পনা করে গেছে বার বার। এতোটাই নিপুন সেই পরিকল্পনা তা যেকোন থ্রিলার মুভির স্টোরি হতে পারতো।....সেদিন ওর চোখের জল যেনো বাঁধ মান ছিলো না।
মালব্যর থেকে দূরে সরে যাওয়ার পরে সে, এই সমাজের বহু রূপ ও রঙ দেখেছে। বিমলাকে কেউ করেছে বাঁকা উক্তি কেউ আবার এমনও প্রস্তাব দিয়েছে, বাচ্চার মা তো তাই সম্পর্কযুক্ত হওয়া যায় কিন্তু পুনরায় বিবাহ নয়। এমনি নগ্ন কিছু পলেস্তারা খসা সমাজের মুখোশ। চিরকাল সেসবকে সরিয়ে বাচ্চাকে আগলে মাথা উঁচিয়ে চলেছে সে। তবে এই কঙ্কালসার সমাজে আবার কেউ কেউ সভ্যতার, ভদ্রতার সম্পর্কে ও লালনপালন করেছে তাকে।
এ যেন সূর্যাস্তের মধ্যেও সূর্যালোকের বিচরণস্থল।
মানিক মানে বিমলার ছেলের এখন সাত বছর বয়স। মা বাবা ছেলেকে নিয়ে নিজে ড্রাইভিং করছে ও কুয়াশা ঘেরা পাইন গাছের অলি গলিতে ঘুরছে। পূর্ব হিমালয়ের পৃথিবীর সমৃদ্ধতম বনভূমি সংলগ্ন এলাকায়। কিছু সেলফি তুলে পাঠিয়েছে ও আমায় হোয়াটসঅ্যাপে। তার সাথে শেয়ার করেছে সেই আবেগকে।
বিমলার মানিক বলে উঠলো,'মাম্মাম পাইনা...পাইন।' বিমলা এক হাতে মারুতি ব্যালেনোর স্টিয়ারিং ধরেছে, ছেলের মাথায় আর এক হাত দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মতো হেসে বলে উঠলো,'হ্যাঁ বাবা পাইন।....আমরা করবো জয়। আমরা করেছি জয়।'
...মালব্য চলে গেলো,চাকরি গেলো, আত্মসম্মানী মেয়েটা হাল ছাড়ে নি। পুরানো চাকরিতে তখন তার ফেরা হয় নি। নানাবিধ বাস্তবিক সমস্যার কারণে। ভীষণ ভালো রান্নার হাত ছিলো ওর। তেমনি ছিলো ছাত্র/ছাত্রীদের পড়ানোর দক্ষতা। কারোর কাছে হাত পাতে নি অভিমানী মেয়েটা। নিজের হাতের ভরসাতেই খুলে ছিলো রেঁস্তরা 'জোনাকী'। পাশে কোচিং সেন্টার। শুরুটা ছিলো কিছুটা এমন.....যারা পড়তে আসতো তাদের জন্যে সেদিনকার স্পেশাল ডিশ ছিলো ফ্রি। তারপরে ছিলো বিক্রি ..... সেখান থেকে জোনাকীর জয় যাত্রা শুরু হলো। এখন ওর এই শহরে ৩ টে রেস্তোরাঁ। দুটো কোচিং সেন্টার। প্রথম দু'বছর ছিলো প্রচুর কষ্টের পথচলা এখন বহু মানুষ আসেন জোনাকী তে খাওয়ার খেতে, দেওয়ালে আঁকা একটি মহিলার স্কেচ দেখে জিজ্ঞাসা করে। ইনি কি মালকিন? এনার দেখা পাব কিভাবে?...... কর্মচারীরা উত্তর দেন... ইনি ভীষণ ব্যস্ত দেখা করেন না কারোর সাথে। এক মাস আগে থেকে দেখা করার জন্যে নাম লিখিয়ে যেতে হয়। কারণ ইনি ছাত্রছাত্রীদের সাথে ফাঁকা সময়ে ঘোরেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।
জোনাকীর ভ্রমণ নামক ট্রাভেল এনারই।
… উত্তর আসে ‘ও তাই না কি’ !!
(সব চরিত্র কাল্পনিক)
CATEGORIES কবিতা