মাষ্টার মহাশয়
সাবিত্রী দাশ (নন্দীগ্রাম, পূর্ব মেদিনীপুর)

গ্রামের এক মাষ্টারমশাই ছিলেন বেশ হাসিখুশি। শরীরটা হাস্যস্পদ হলেও মাষ্টারমশাই কে দেখলে কেউ হাসে না। এক সময় উনার কোচিং সেন্টার ছিল। সেই কোচিং এ যে সকল ছাত্র ছাত্রীরা পড়তেন তারা নিশ্চিত ছিল যে তারা পাশ করবে। মাষ্টারমশাই কে যে যা খুশি বেতন দেয়। উনি অল্পতেই খুব খুশি হতেন। সবসময় উনি একটা কথা বলতেন - শিক্ষা বিক্রি করতে নেই। এলাকায় মানুষের কাছে মাষ্টারমশাই ছিলেন ভগবান। সবার বিপদে উনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন। উনার কাছে কেউ সাহায্য চাইতে এলে কখনও ফিরে যায়না।
একদিন মাষ্টারমশাই এর কাছে এই গ্রামের একজন মাসি এলেন, ময়না মাসি। খুব টিক টিকে বিধবা মহিলা। সোজাসুজি অপ্রিয় সত্য কথা বলতে তার ঠোঁট সহজে কাঁপে না। মাসির স্বামী বহুদিন আগেই মারা গেছেন। ছেলেরা বিয়ে করে অন্য জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। নিজের বিশাল বাড়িতে উনি একা থাকেন। ছেলেরা মায়ের খবর কেউ রাখেনা। মাসির আবার সে সব নিয়ে কোন দুঃখ নেই। তিনি নিজের দুঃখের কথা কাউকে বলা পছন্দ করেন না। একটিই রোগ আছে মাসির, পরের খবর নিয়ে বেড়ানো। এই বদরোগের জন্য পাড়ার মানুষেরা তাকে দেখলেই দূরে সরে যায়। মাসি একদিন মাষ্টারমশাইকে বললেন আপনি এত দয়া মায়া দেখাচ্ছেন এতে লাভ কি ? পরে পস্তাতে হবে। মাসির কথা শুনে মাষ্টারমশাই বললেন- কি বলছেন ? আপনার কথা আমার এই ছোট্ট মাথায় ঢুকল না। দূরে কেন ভেতরে এসে বসুন।
মাসি চেয়ারে এসে বসলেন। বললেন আজ কি কোচিং বন্ধ ? মাষ্টারমশাই বললেন -আজ সোমবার। এইদিন আমার স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন। এই দিনটিতে তার ছবির সামনে বসে আমি তার কথায় ভাবি। মাষ্টারমশাই এর কথা শুনে ময়না মাসি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবেন- তারও তো স্বামী মারা গেছেন বহু আগে। কিন্তু তিনি তো তার মৃত্যুর দিন কখনও স্মরণ করেন নি।
মাষ্টারমশাই সহজ সরল ও সৎ মানুষ। সেই কারণেই এলাকার মানুষের কাছে উনি ভগবান। ছোট বড় সবাই উনাকে মান্য গণ্য করে। মাসি আর কথা না বলে বাড়ি চলে গেল।
মাষ্টারমশাইয়ের তিন ছেলে। একজন ডাক্তার এবং বাকি দুই জন শিক্ষক। আশ্চর্য ব্যপার তারা কেউই মাষ্টারমশাইয়ের আদর্শকে ধরে রাখতে পারেনি। বিয়ের পরে ওরা অন্য যায়গায় চলে যায় ,উনি তখন বড্ড একা , মাঝে মাঝে উনার মনটা বড় ফাঁকা ফাঁকা মনে হয় , বয়স হয়েছে কোচিং আর নেই ,যারা পড়তে তাদের অনেকেই চাকরি পেয়ে গেছে , মাষ্টারমশাই একদিন তার বারান্দায় বসে তাদের উঠানে একটি আম গাছ ছিল , গাছটির বয়স অনেক বছর , গাছটি শুকিয়ে গেছে ,এখন আর ঐ গাছটিতে কোন পাখিরা এসে বসেনা , ঐ আম গাছটার দিকে তাকিয়ে মাষ্টারমশাইএর জীবনের বহু স্মৃতির পাতা খুলে দেখেন ,এ দিকে ময়না মাসি লাঠি নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাষ্টারমশাইএর বাড়িতে এলেন , আস্তে আস্তে উনার কাছে বসলেন , মাষ্টারমশাই জিঞ্জেস করলেন কেমন আছেন ? মাসি বললেন ভালোই আছি ,আর আপনি ? মাষ্টারমশাই বললেন আমিও বেশ ভালো আছি , মাসি বললেন আমি জানি আপনি ভালো নেই , একদিন বলেছিলাম বেশি দয়ামায়া দেখাবেন না পরে পস্তাতে হবে , কথাটা মিলল তো ,? মাষ্টারমশাই মাসির দিকে তাকিয়ে থাকলেন ,মাসি বলল ,কেউ না জানুক আমি জানি এই এলাকার বেশিরভাগ ছেলে মেয়ে আপনার কাছে লেখা পড়া করে বড় হয়ে মানুষ হয়েছেন, সবাই এখন প্রতিষ্ঠিত , আপনি কখন ও শিক্ষা বিক্রি করেন নি , যে যা দিয়েছেন তাই গ্রহণ করেছেন , আমি জানি আজ কেউ আপনার সাথে যোগাযোগ রাখে না , মাষ্টারমশাই বললেন থাক ও সব কথা , স্ত্রী যখন মারা গেল , তিন ছেলেই তখন নাবালক ,কি ভাবে যে ওদের মানুষ করেছি তার আমিই জানি , নিজের ছেলেরা যখন বাবাকে দেখভাল করেনা ,পরের ছেলে মেয়েরা এগিয়ে আসবে সে কথা ভাবতেই পারিনা , মাষ্টারমশাই আরোও বললেন মানুষ সব কিছু চাইলেই পায় না , কিছু কিছু পাওয়া না পাওয়াই হয়ে থাকে , তাই তো আমি কষ্ট সহ্য করতে করতে পাথর হয়ে গেছি ,কোন দুঃখ কষ্ট এখন আর দুঃখ কষ্ট বলে মনেই হয় না ,,
পৃথিবীর সকল মাষ্টারমহাশয়ের চরনে আমার বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি ,,,
সবারে মানুষ করিতে তুমি
দিয়েছো অভয় বাণী
তাই তুমি আছো মোদের হৃদয়ে
এই সত্য মানি ,,,
CATEGORIES কবিতা