
রূপনারায়নপুরে অরিজিতের ‘হিরোইজম’ নাকি হাস্যকর নাটক? রাজনৈতিক প্রচারে বিজেপি নেতার অদ্ভুত কাণ্ড!
কৌশিক মুখার্জী: সালানপুর:-
রূপনারায়নপুরের মহাবীর কলোনি এখন রাজনৈতিক নাটকের মঞ্চ। আর এই নাটকের নায়ক, বা বলা ভালো, ‘স্বঘোষিত ত্রাণকর্তা’ হলেন বিজেপি নেতা অরিজিৎ রায়। একটি সাধারণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিনি যে হৈচৈ শুরু করেছেন, তা এখন স্থানীয়দের মুখে হাসি আর ক্ষোভ দুইয়েরই উৎস। তবে এই নাটকের প্লটে এমন সব টুইস্ট রয়েছে, যা হয়তো বলিউডের ব্লক বাস্টারকেও হার মানাবে।
ঘটনার শুরু মহাবীর কলোনির বাসিন্দা শমীক হালদারের উপর কথিত হামলার অভিযোগ নিয়ে। অভিযোগ, সালানপুর ব্লক তৃণমূল কংগ্রেসের সহ-সভাপতি ভোলা সিংয়ের নেতৃত্বে একদল তৃণমূল কর্মী সমীককে মারধর করেছে।এরপর সমীকের পরিবার রূপনারায়নপুর পুলিশ ফাঁড়িতে ছুটে যায়,কিন্তু সেখানে সহযোগিতার বদলে তাদের কপালে জোটে পুলিশের ধমক আর ‘ঘর ছাড়ার’ হুমকি!হতাশ পরিবার তখন তাদের ‘অশোকাস্ত ‘র’ খোঁজে বিজেপি নেতা অরিজিৎ রায়ের দ্বারস্থ হন।এখান থেকেই শুরু হয় অরিজিতের ‘হিরোইক’ অভিযান। কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে তিনি প্রথমে সমীকের বাড়িতে হাজির। পুলিশের ভূমিকা জানার পর তাঁর রক্ত গরম!সোজা রূপনারায়নপুর ফাঁড়িতে ঢুকে তিনি পুলিশের উপর চড়াও হন। চিৎকার, হুমকি, আর কর্তব্যের পাঠ—অরিজিতের মুখে যেন সব মিলেমিশে একাকার। ভোলা সিংয়ের নামে ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে তিনি পুলিশকে তুলোধনা করেন। আর এই পুরো নাটকটি তিনি সামাজিক মাধ্যমে লাইভ প্রচার করে নিজেকে ‘জনতার মসিহা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু হায়, তাঁর সবচেয়ে বড় ‘ডায়লগ’টি ছিল সমীকের পরিবারকে বলা—“তোমরা বিজেপি করো, তারপর দেখছি কে কী করে!” বাহ! এ যেন স্পষ্ট বার্তা—বিজেপির পতাকা না তুললে ন্যায়ের আশা ফিকে!
কিন্তু গল্প এখানেই থামেনি। মহাবীর কলোনির বাসিন্দারা পুলিশ ফাঁড়িতে লিখিত অভিযোগ দিয়ে যে তথ্য তুলে ধরেছেন, তা অরিজিতের ‘হিরোইজম’-এর বেলুন ফুটো করে দিয়েছে। তাদের দাবি, সমীক হালদার দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। পাড়ায় তাঁর উৎপাতের তালিকা লম্বা—কখনো বাড়ির পাঁচিল ভাঙা, কখনো মহিলাদের হয়রানি, কখনো আঘাত করা। পাড়ার মানুষ তাঁর জন্য আতঙ্কিত, এবং এর আগেও থানায় অভিযোগ জানিয়ে চিকিৎসার আবেদন করেছেন। এই তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই অরিজিতের ‘ন্যায়ের লড়াই’ হাস্যকর নাটক বলে মনে হচ্ছে। তিনি কি তাড়াহুড়োয় না জেনে-বুঝেই এই নাটক মঞ্চস্থ করলেন?
অরিজিৎ অবশ্য পিছপা নন। তিনি দাবি করেছেন, পুলিশকে কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি, শুধু ‘কর্তব্যের কথা’ স্মরণ করিয়েছেন। তিনি তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের পুলিশের প্রতি অবমাননাকর আচরণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, তৃণমূলের ইশারায় পুলিশ কেন নাচছে? তবে মজার ব্যাপার, ফাঁড়ির ভিডিওতে তিনি ভোলা সিংয়ের নাম স্পষ্ট উল্লেখ করলেও পরে সংবাদমাধ্যমে ‘অমুক দাদা’ বলে এড়িয়ে যান। এ কি ভয়ে, না কৌশল?
এদিকে, ভোলা সিং এই পুরো ঘটনাকে ‘পাগলের পাগলামি’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর মতে, সমীকের চিকিৎসার প্রয়োজন, আর অরিজিৎ এই মানসিক ভারসাম্যহীন যুবককে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারের খেলায় মেতেছেন। “গত পাঁচ বছর অরিজিৎ কোথায় ছিলেন? এলাকা সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। বিধানসভা নির্বাচনের আগে মিডিয়ার স্পটলাইটে আসতে এই নাটক,” বলে কটাক্ষ করেন ভোলা। সালানপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি মোহাম্মদ আরমানও একই সুরে বলেন, “নির্বাচন এলেই অরিজিতের মতো নেতারা ইস্যু খুঁজে বের করেন। পাগলের পাগলামি হোক, আর যাই হোক, এলাকা গরম করতেই হবে!”
তৃণমূল নেতা শিবদাসন দাশু অরিজিতের আচরণের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “অনুব্রত পুলিশের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে বলে অরিজিৎ ফাঁড়িতে গিয়ে যে ভাষায় চিৎকার করেছেন, তা কি শোভন? এটা কি বিজেপির নীতি?” এদিকে, সাধারণ মানুষ অরিজিতের “বিজেপি করো” মন্তব্যকে হাতিয়ার করে প্রশ্ন তুলছেন—বিজেপি কি শুধু নিজেদের সমর্থকদের পাশে দাঁড়ায়? অসহায় মানুষের জন্য তাদের ন্যায়ের লড়াই কি দলীয় পতাকার রঙের উপর নির্ভর করে?
রূপনারায়নপুরের এই ঘটনা এখন শুধু একটি স্থানীয় বিতর্ক নয়, রাজনৈতিক স্বার্থে মানুষের দুর্দশাকে হাতিয়ার করার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। অরিজিতের হম্বিতম্বি, ফাঁড়িতে চিৎকার, আর সামাজিক মাধ্যমে নিজেকে ‘নায়ক’ হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টা কি সত্যিই ন্যায়ের জন্য, নাকি আসন্ন ২০২৬ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারের মঞ্চ তৈরির কৌশল? সমীক হালদারের মতো একজন অসুস্থ ব্যক্তির জীবন নিয়ে এই রাজনৈতিক তামাশা কতটা নৈতিক, তা নিয়ে রূপনারায়নপুরের মানুষের মনে এখন শুধুই প্রশ্ন আর ক্ষোভ।
