
ধুলোর আড়ালে জীবনের ক্ষয়, পরিবেশ ধ্বংস ও মানুষের দুর্দশার কাহিনি:-
কৌশিক মুখার্জী: সালানপুর:-
পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে, যেখানে শিল্পের গর্জন জীবনের ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে, এক নীরব বিপর্যয় ঘটছে। সালানপুর ব্লকের গ্রাম গুলিতে ক্রেসার ও পাথর কারখানার অবিরাম কাজ চলছে। এই কারখানাগুলি অনেক পরিবারের জীবিকার উৎস হলেও, মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপর ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনছে। এক ৪৫ বছর বয়সী শ্রমিকের গল্প, যিনি শ্বাস নিতে কষ্ট পাচ্ছেন এবং বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছেন, নিয়ন্ত্রণহীন শিল্পের করুণ সত্য প্রকাশ করে।
দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ব্যক্তি মাধাইচকে একটি বেসরকারি
ক্রেসার ও পাথর কারখানায় কাজ করেছেন।প্রতিদিন তিনি সূক্ষ্ম সিলিকা ধুলোর মেঘের মধ্যে শ্রম দিয়েছেন,যা নিঃশব্দে তার ফুসফুসে প্রবেশ করেছে। প্রথমে কাশি,জ্বর,আর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, এবং এখন তিনি পিঠাকিয়ারি গ্রামীণ হাসপাতালে শয্যাশায়ী। গ্রামবাসীদের মনে আশঙ্কা, তিনি সম্ভবত সিলিকোসিসে আক্রান্ত—একটি মারাত্মক রোগ, যা দীর্ঘদিন সিলিকা ধুলোর সংস্পর্শে এলে হয়। তবে স্বাস্থ্য আধিকারিকরা বলছেন, তার যক্ষ্মা ধরা পড়েছে, এবং ওষুধ ও একজন সমাজসেবীর দেওয়া পুষ্টিকর খাবারে তিনি সুস্থ হচ্ছেন। এই দ্বন্দ্ব—গ্রামবাসীদের ভয় আর চিকিৎসকদের বক্তব্য—এক গভীর প্রশ্ন তুলছে:ধুলোর আড়ালে কি সত্য চাপা পড়ছে?
ক্রেসার ও পাথর কারখানার পরিবেশগত ক্ষতি অস্বীকার করার উপায় নেই।এই শিল্পগুলি প্রায়ই ন্যূনতম তদারকিতে চলে,বাতাসে বিষাক্ত কণা ছড়িয়ে দেয়, জলাশয় দূষিত করে,এবং আশপাশের গ্রাম গুলোকে ধুলোর আস্তরণে ঢেকে ফেলে।পাতালের এই শ্রমিকের মতো,যারা কোনো প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম বা স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াই কাজ করেন,তারাই প্রথম ক্ষতির শিকার হন।সিলিকোসিস,যদি সত্যিই তার রোগ হয়,তবে যথাযথ চিকিৎসা ছাড়া মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়—ধীরে ধীরে শ্বাস বন্ধ করে দেয়।যদি যক্ষ্মাই সঠিক রোগ হয়, তবুও মূল সমস্যা অপরিবর্তিত: অপুষ্টি,অপ্রতুল যত্ন,আর বিপজ্জনক কাজের পরিবেশ রোগের জন্য পথ প্রশস্ত করে।
এটি কোনো একক ঘটনা নয়। ভারতজুড়ে অসংখ্য শ্রমিক এমনই অনিয়ন্ত্রিত শিল্পে কাজ করেন, তাদের শরীর মুনাফার পেছনে বলি হয়।পরিবেশের উপর কঠোর নিয়মের অভাব এবং শ্রমিকদের সুরক্ষার ঘাটতি এই সংকটকে আরও গভীর করে। সালানপুরে স্থানীয় প্রশাসন তদন্ত শুরু করেছে, কিন্তু পদক্ষেপের গতি সমস্যার তীব্রতার তুলনায় ধীর।কারখানা মালিকের পরামর্শ—এই অসুস্থ শ্রমিককে চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য পাঠানো—একটি উদাসীন প্রস্তাব, যা আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারের পক্ষে অসম্ভব।এটি তাদের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ।
এর প্রভাব অনেক দূরব্যাপী।
ক্রেসার ও পাথর কারখানার মতো শিল্প শুধু বাতাসকে বিষাক্ত করে না,জীবনকেও বিষিয়ে তোলে। পরিবার তাদের উপার্জনকারী সদস্যকে হারায়,সম্প্রদায় হারায় আশা,আর ভূমি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়,কারখানার ধ্বংসলীলায় জর্জরিত হয়।পাতালের এই শ্রমিক, সিলিকোসিস হোক বা যক্ষ্মা, একটি বৃহত্তর ব্যবস্থাগত ব্যর্থতার প্রতীক—যেখানে মানুষের জীবনকে তুচ্ছ মনে করা হয়,আর পরিবেশের জবাবদিহি পিছনে পড়ে থাকে।
পরিবর্তন অসম্ভব নয়,তবে তা জরুরি পদক্ষেপ দাবি করে। কারখানার কাজে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষা,এবং শক্তিশালী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এই দুর্দশা কমাতে পারে। স্থানীয় প্রশাসনকে তদন্তের বাইরে গিয়ে বাস্তব সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।পাতালের মানুষের জন্য এই লড়াই শুধু পরিষ্কার বাতাসের নয়, মর্যাদা,স্বাস্থ্য,আর বেঁচে থাকার। ধুলো মিটে যেতে পারে,কিন্তু নিষ্ক্রিয়তার মূল্য থেকে যাবে—একটি একটি করে শ্বাসে জীবন হারিয়ে যাবে।