ওদের জীবনে হাসি নাই!

ওদের জীবনে হাসি নাই!

রিমা ঘোষ-: মাথায় আছে পাহাড় প্রমাণ চাপ! আক্ষরিক অর্থে ওদের পিঠে আছে বস্তা বোঝাই চাপ। তীব্র বেকার সমস্যার যুগে শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের অলিগলিতে পিঠে ভারি ব্যাগের বোঝা চাপিয়ে মোটরসাইকেলে চেপেও ওরা যেন ছুটে বেড়াচ্ছে! ব্যাগে আছে সংসারের টুকিটাকি জিনিস থেকে শুরু করে কোনো এক প্রেমিকার আব্দারের শখের জিনিস। কেউ আবার নিজের পরিবারের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অপরের বাড়িতে সঠিক সময়ে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছুটে চলেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেকেই না ফেরার দেশে চলেও যাচ্ছে। মানুষের কাছে ওদের পরিচয় ওরা ডেলিভারি বয়- আধুনিক যুগে মানুষের শখ মেটানোর যন্ত্র। এখন অবশ্য এই পেশায় মেয়েদেরও দেখা যাচ্ছে। বিনিময়ে সামান্য উপার্জন ওদের হয় - প্রতি ডেলিভারির জন্য ৮ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা! সংস্থা ভেদে আয়ের পরিমাণ সামান্য কমবেশি হয়। ওদের জীবনে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা বলে কিছু নাই। নাই কোনো ছুটি, ডিএ, পেনশন বা অন্য কোনো সুযোগ সুবিধা। ওরা সুযোগ সুবিধাহীন নেই রাজ্যের বাসিন্দা, পুঁজিবাদী সমাজের রোবট! ওদের একটাই মন্ত্র - গতি। এই গতি বাড়াতে গিয়ে গতও হতে হয়! সকালের সূর্য ওঠার আগেই ওদের কাজ শুরু হয়ে যায়। অফিস থেকে জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে। তারপর জিনিসপত্র প্রাপকদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসে অফিসে। যে খাবারের জন্য এত লড়াই, সবদিন ঠিকমত খাওয়া হয়না। সবকিছু বুঝিয়ে বাড়ি ফিরতে যথেষ্ট রাত হয়ে যায়। তাদের শিশু সন্তান তখন বাবার অপেক্ষায় থেকে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত শিশুর কপালে স্নেহচুম্বন দিয়ে নিজের ক্লান্ত শরীরটা টানতে টানতে কোনোরকমে দু'মুঠো খেয়ে সেও বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া ভুলে যেতে হয়। দূরত্ব কম হলেও যেসব ডেলিভারি বয়রা 'হোম ডেলিভারি'-র খাবার পৌঁছে দেয় তাদের চাপ আবার অন্যরকম। অর্ডার দেওয়ার ৫ থেকে ৬ মিনিটের মধ্যে ৫-৬ কিমি. বা তার বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে খাবার পৌঁছে দিতে হবে। এটা করতে গিয়ে সেদিন অকালে ঝরে পড়ল একটা টাটকা জীবন! অথচ একটু অপেক্ষা করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হতোনা। মানুষের মত দেখতে হলেও মনুষ্যত্ব শব্দ বন্ধনী তারা নিজেদের অভিধান থেকে মুছে দিয়েছে! এত কিছুর পর এদের জীবনে জোটে অবজ্ঞা, অবহেলা। তীব্র গরমে ওরা যখন লোকের দরজায় এসে দাঁড়ায় কেউ ওদের মুখে তুলে দেয়না এক গ্লাস জল। কোনো কবি ওদের নিয়ে এক লাইন কবিতা লেখেননা। কোনো গায়ক গেয়ে ওঠেননা -'ও বন্ধু একটু সহানুভূতি কী ওরা পেতে পারেনা...'। তবুও সব সহ্য করেও এরা হাসিমুখে আমাদের বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের সখের জিনিস। আজও সমাজের চোখে ওরা সামান্য 'ডেলিভারি বয়'!

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )