পেনদানি

শম্পা মহান্তি (কলকাতা)

সেদিন শ্রীময়ি ম্যাডাম তাঁর কাজের ঘরের বুক স্লেফ থেকে শুরু করে পেন,পেন্সিল,রাবার,সহ প্রতিটি ছোট ছোট জিনিসপত্র গুলো খুব যত্ন করে সাজিয়ে রাখছিলেন।
অম্বিকা ম্যামের একমাত্র মেয়ে। বলে উঠলো,’মা যে পেনগুলোতে কালি নেই,সেগুলো কেন রেখেছো বলতো। কোন মানে হয়। কি যে তোমার ভালো লাগে ওসব , বুঝি না। দাও দেখি ফেলে দি, পেনদানিতে কিছু নতুন পেন,পেন্সিল রাখি।’….’এই….ই….খবরদার না। এসবে যদি হাত দিয়েছিস তাহলে তোর এক দিন কি আমার একদিন, তোর মায়ের রুদ্রানী রূপ দেখবি তাহলে।….আমি ঘরে না থাকলেও এসব ফেলার চেষ্টা করবি না যেনো।’

আমি ম্যামের বহু ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে একজন। সেদিন ম্যামকে ঘরের বাগানের কিছু ফুলের চারা গাছ দিতে গিয়ে ছিলাম। গিয়ে মিষ্টি,ইডলি খেতে খেতে উনাদের মা মেয়ের এসব কান্ডকারখানা বসে বসে দেখ ছিলাম। মনে মনে ভাব ছিলাম, সত্যিই তো ম্যাম শুকিয়ে যাওয়া পেন গুলোকে কেন এমন আগলে রেখেছেন পেন দানিতে,তাও চোখের সামনে করে রেখেছেন।

জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে হচ্ছিল ভীষণ কিন্তু মনে সাহস হচ্ছিল না। আসলে মানুষটার যেমন আপোষহীন স্নেহ দেখেছি পেয়েছি, তেমনি তো এক শান্ত দৃঢ় ব্যক্তিত্ব অনুভব করেছি। ঠিক যেমনটি পাহাড়ের সৌন্দর্য আবার দৃঢ়তা মানুষকে বার বার আকর্ষণ করে প্রশস্তি দেয় তেমনই ; আবার পাহাড় কে জানতে বুঝতে গেলে…..বহুদূর হাঁটলে হাঁপিয়ে যেতে হয়, কিছুটা বিশ্রাম আবার সেই পাহাড়ের কোলেই নিতে হয়, ফের তার সৌন্দর্য কে উপলব্ধি করার তীব্র বাসনায় , ঠিক তেমনই ব্যক্তিত্বের মানুষ হলেন আমাদের শ্রীময়ি ম্যাডাম।

শুনেছি উনার একটা প্রিয় ব্যাচ্ ছিলো। একদল দামাল , কলেজের রকে বসে আড্ডা দেওয়ার কিছু তথাকথিত বকাটে ছেলে। ওরা একবার কলেজ থেকে রাস্টিকেট হওয়ার অবস্থাতেও ছিল, এখন ওরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ঘর সংসার হয়েছে ওদের। গেলো কলেজ শোস্যালে ওরা ম্যাডামকে খুঁজতে এসেছিল দেখা না পেয়ে সব উপহার গুলো কলেজের সবুজ মাঠেই এলোমেলো করে ফেলে, চোখের জলে বাড়ি ফিরে ছিলো।

এসব ম্যামের মেয়ের থেকে শুনেছিলাম। কিন্তু কেনই বা ভাবছি এখন এসব। ইডলি খাওয়া খতম আমার। মিষ্টি গুলো ছাড়া যাবে না। সেসব মুখে পুরে জল খেয়ে সবে উঠবো, এমন সময়ে সেই স্নেহ ভরা মুখটি সামনে এসে বললেন,’এই তোকে একটা দায়িত্ব দেবো, করে দিবি? আমার মেয়েকে দিতে চাই না।…..হ্যাঁ …. কি …. না।’…..আমি উত্তর দিলাম হ্যাঁ ম্যাম অবশ্যই করে দেবো,বলুন না কি করবো।

কিছু সময় পরে,শ্রীময়ি ম্যাম একটা আবছা হয়ে যাওয়া কিছু লেখালিখি আমায় দিলেন। দেখে মনে হলো কিছু টুকরো খোলা চিঠি,কেউ কোন কালে ম্যাডাম কে হয়তো দিয়ে ছিলো। সেসবের লেখা বেশ অস্পষ্টতায় ভরা।
আচ্ছা ম্যাম কি করবো? এসব ভালো করে বাঁধাই করে এনে দিবি বুঝলি। আমার পুরানো কলেজের রাস্তায় একটা ভালো দোকান আছে, আজ প্রায় বছর পঁচিশ হলো , সেখানে যাওয়া আসা নেই আমার। কিছু স্মৃতি সেসব আমার মন জুড়ে বাসুকি নাগের মতোই গলায় বসে আছে মহা শান্তিতে,গলার বাইরে তাদের বেরনো মানা। কারণ কন্ঠে পাহারা রত অদৃশ্য বাসুকি নাগ যে,বুঝলি।

এই প্রথমবার ম্যামকে বুঝতে পারলাম না। কি যে বলে গেলেন নিজের মতো করে। যাইহোক আমি ঠিক আছে বলে, সেসব নিয়ে শ্রীময়ি ম্যাডামের ঘর থেকে বেরোলাম।

ঘরে ফিরে সারাদিনের মধ্যে খালি মনে হতে লাগলো,ম্যাম কি বললেন আর কেনই বা বললেন, ওই অস্পষ্ট চিঠিগুলো একবার সন্ধ্যায় চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কৌতূহলী হয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। কিছুটা পড়া গেলো, ….. আমরা আপনার সেই ব্যাচ্ ম্যাম যাদের কলেজে রাখার জন্যে আপনি নিজের ইস্তফা দিতেও রাজি ছিলেন। আমরা কতো বদমাইশি করেছি, প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে কতো বাঁচিয়েছেন। তখন তো শুধুমাত্র ‘টিচার্স ডে’ তে ২/৩ টাকার পেন দিতাম কিনে আপনাকে, এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছি,কলেজে এলাম আপনাকে পেলাম না যে,…..আমাদের দেওয়া পেনগুলো এতোদিনে নিশ্চয় নেই আর আপনার কাছে …….জানেন তো আপনার পচা,বিটু,বাবাই এর জামায় ক….কালি….আজও লে…..গে, তারপরের লেখাগুলো আবছা ভীষণ কেউ তার উপরে কোন শেষে হয়ে যাওয়া পেনের কালি দিয়ে কিছু লেখালিখিকে জীবন্ত করার চেষ্টা করে ছিলেন, কিন্তু কালিটা ছড়িয়ে গেছে। তাই পড়া হলো না।

মনে হয় পেনের কালিটা শুকিয়ে গেছে কিন্তু পেনগুলোতে হয়তো কারোর মায়া লুকিয়ে রয়েছে। লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর আপত্য স্নেহের পরশ। শুনেছিলাম ম্যামের এক ছেলে ছিলো,সে আর নেই। নেই স্বামী সংসারের ইতিকথা। কারোর সম্মুখে বেরোন না উনি , বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া। উনার একটা ছোট্ট ঘর জুড়ে কিছু ছাত্র/ছাত্রীদের দেওয়া বাঁধাই করা চিঠি মানপত্র ও পেনদানির সমাহার দেখি। সেসব যেনো উনার ব্যাঙ্কের লকারে রাখা অলংকারের মতো। কাউকেই ছুঁতে দেন না,নিজে নিজে পরিস্কার করেন,যত্নে দেখেন আর মুচকি মুচকি হাসেন।

…….আমি ভাবি, পেনের কালিরাশি কি সত্যিই শুকনো না কি ; জীবন্ত হয়ে রয়েছে অন্য পথে অন্য কোন পেনদানিতে!

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )