(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
পরিচয়

মৌসুমী মন্ডল (কলকাতা)
ঝলসানো রোদ সেদিন ছিলো, ট্রেন ভ্রমনের শেষে,
হন্যে হয়ে রিকশা খুঁজি ঘাম ঝরঝর বেশে।
মফস্বলের ছোট্ট শহর, রাস্তা রোদে পোড়ে,
একটি রিকশা হঠাৎ দেখি দাঁড়িয়ে আছে দূরে।
হাত বাড়িয়ে ডাকতে সেটা দ্রুতই এলো চলে,
“মা জননী, কোথায় যাবেন?” রিকশাওয়ালা বলে।
কোথায় যাবো বলে তারে শুধোই, “ভাড়া কত?”
লোকটা বলে, “ন্যায্য ভাড়া দেবেন বিবেকমতো।”
রিকশা চলে, ক্লান্ত আমি মুছি মুখের ঘাম,
এরই মাঝে রিকশাওয়ালা শুধায় আমার নাম।
কোথায় থাকি,কোন শহরে, সবই জানতে চায়,
বিরক্তিতে ভুরু আমার খানিক কুঁচকে যায়।
অস্বস্তিটা চেপে রেখে বললাম সবকিছু,
সব শুনে সে মিষ্টি হাসে, বারেক ফিরে পিছু।
“মা জননী, ভাবেন বুঝি, কোথাকার কোন কে,
সাহস কত, আমায় এ্যাতো প্রশ্ন শুধাচ্ছে!
মনে কিছু নেবেন না মা, পাবেন না কো ভয়,
আচ্ছা তবে দিচ্ছি আমি আমার পরিচয়।
মিষ্টি একটা কন্যা আমার, পুত্রটা ডানপিটে,
দুজনই মা পড়ছে জেলার সেরা বিদ্যাপীঠে।
পড়াশুনায় খুব ভালো মা, ভালো রেজাল্ট করে,
স্কুলের সবাই ওদের কথা বলে গর্ব ভরে।
কিন্তু জানেন? আমার মনে একটা লজ্জা-কাঁটা,
আমি যে মা রিকশা চালাই, কেউ জানেনা সেটা।
কি করবো মা, গরীব মানুষ, পয়সা কোথায় অত?
কত্ত টাকা লাগে ওদের, খরচা পড়ায় কত!
খরচ দিতে আমি মা আজ রিকশা চালাচ্ছি,
গ্রামের মাটি ছেড়ে দূরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
ওরা যদি জানে, ওদের বাবা রিকশা চালায়,
হেঁট হবে মা মাথা ওদের, অপমানের জ্বালায়।
তাই বলিনি কাউকে কিছু, একলা কষ্ট করি,
রূপোর জলে একলা ভিজি, সোনা রোদে পুড়ি।”
মুগ্ধ হয়ে রিকশাওয়ালার গল্প শোনার ফাঁকে,
দেখি, কখন পৌঁছে গেছি বাবার বাড়ির বাঁকে।
ভাড়া দিতে তারে, অধম হাতটা আমার কাঁপে,
কোন টাকাতে ঋণ চুকাবো, মাপবো বা কোন মাপে?
দুঃসাহসী দুচোখ মেলে চাইলাম তার মুখে,
দেখতে পেলাম প্রশ্ন আরো জমেছে তার চোখে।
“মা, আমার এই সন্তানেরা নামী যেদিন হবে,
চিনবে তাদের অনেক মানুষ, দেশ দুনিয়ার সবে।
জানবে তারা যখন, তাদের রিকশাওয়ালা পিতা,
আপন করতে আমায়, তাদের হবে কি অসুবিধা?”
এ জিজ্ঞাসার জবাব দেবো, সাধ্য আমার নাই,
বাক্যহারা চোখে আমি সম্মুখপানে চাই।
রিকশাঅলা হেসে বলে, “কি যে যা-তা বকি,
সন্তান আমার থাকুক সুখে, আর কিছু চাই নাকি!
নাই বা দিলো কোথাও ওরা আমার পরিচয়,
আমার স্নেহ এ্যাতোটুকু কমবে না নিশ্চয়।”
রিকশাওয়ালা যাচ্ছে ফিরে, তুফান আমার মনে,
কার সাথে আজ দেখা হলো, কোন সে পূণ্য-গুণে!
রিকশাওয়ালা? না, না, সে তো রিকশাওয়ালা নয়,
এই জগতের শ্রেষ্ঠতম “বাবা” এরেই কয়!