মাহেশের রথযাত্রার ঐতিহাসিক কাহিনী

মাহেশের রথযাত্রার ঐতিহাসিক কাহিনী

শিবানী চক্রবর্তী, শ্রীরামপুর, হুগলী-: হুগলীর শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা জগৎবিখ্যাত। পুরীধামের পরেই মাহেশের রথের সুনাম এবং এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা। শ্রীরামকৃষ্ণ দেব, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের মত বহু অবতারের পদধুলিতে শ্রীপাঠ মাহেশ ধন্য ও মহাতীর্থে পরিণত হয়েছে। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের 'রাধারানী' উপন্যাসে মাহেশের রথযাত্রাকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে দিয়েছে। সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ মন্দির প্রথম অবস্থিত ছিল মাহেশের বর্তমান জগন্নাথ ঘাটের পাশে। ভাগীরথীর পশ্চিম পাড় ক্ষয়প্রাপ্ত হতে শুরু করলে কলকাতার পাথুরিয়া ঘাট নিবাসী দানবীর নয়নচাঁদ মল্লিক বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন। জগন্নাথ দেবের ভোগ রন্ধন হয় কাঠে। রন্ধনে সৈন্ধব লবণ ও ঘৃত ব্যবহৃত হয়। আতপ চাল বা গোবিন্দভোগ চালের পরমান্ন ও অড়হর ডাল রন্ধন হয়। বিশেষ দিনে পোলাও ভোগ, ছানার ডালনা, ধোকা, মালপোয়া, মিষ্টান্ন নিবেদন হয়। সন্ধ্যা আরতিতে লুচি ভোগ ভোগ নিবেদন করা হয়। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার স্নানযাত্রার তিথিতে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের বিগ্রহকে স্নান মঞ্চে নিয়ে আসা হয় এবং রিষড়ার কুমোর পরিবারের আনা সুগন্ধি কর্পূর দেওয়া কলাপাতায় মোড়া মাটির কলসির গঙ্গাজল ও দেড় মণ দুধ দিয়ে স্নান করানো হয়। স্নানযাত্রার একদিনের পর মন্দিরের মূল যাত্রাপথ বন্ধ হয়। এই সময়ে বিগ্রহ ত্রয়ের অঙ্গরাগ সাধন করা হয়। এতে কোন রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হয় না। কাজল লতা বা কালো ভুষি থেকে কালো রং, সাদা শঙ্খ বা সাদা খড়ি থেকে সাদা রং, পুনস থেকে লাল রং তৈরি হয়। এই সময়ে বিগ্রহের গায়ে উত্তাপ অনুভব করা যায়। বলা হয় জগন্নাথ দেবের জ্বর হয়েছে। শুভ অমাবস্যা তিথিতে মন্দিরের দরজা খোলা হয়। উক্ত দিবসে প্রভুকে অলংকার ও মালা দিয়ে সাজানো হয়। এই সময়ে মিষ্টান্ন নিবেদন করেন ভক্তরা। হোম যজ্ঞের মাধ্যমে বিগ্রহ ত্রয়ের অভিষেক, প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও চক্ষুদান হয়। মাহেশের এই উৎসবকে বলা হয় নবযৌবন উৎসব। কথিত আছে, ১৭৫৭ সালের মে মাস নাগাদ কৃষ্ণরাম নামে জনৈক ব্যক্তি এক বিশাল পঞ্চচুড়া বিশিষ্ট কাঠের রথ তৈরি করে দেন। ওই রথটিতে এক গ্রামবাসী আত্মহত্যা করায় সেটি বাতিল করে দেওয়া হয়। এরপর ১৮৬৫ সালে রাম বাহাদুর কালাচাঁদ একটি রথ তৈরি করে দেন। ১৮৮৪ সালে জগন্নাথ মন্দিরের সেবাইতদের সঙ্গে বল্লভপুর সেবাইতদের দাঙ্গার সময় রথটি আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। তাই ওই বছরটিকে কালো বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এরপর পরম ভক্ত মহান দাতা দানবীর দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু বহু অর্থ ব্যয় করে বর্তমান রথটি তৈরি করেন। এই রথটি তৈরি করতে আনুমানিক কুড়ি লক্ষ টাকা খরচ পড়ে। রথটির উচ্চতা ৫০ ফুট, ওজন ১২৫ টন। রথটি চার তলা বিশিষ্ট। আটটি ছোট ও একটি প্রধান চূড়া নিয়ে মোট নটি চূড়া আছে ।১২ টি চাকা ও ৯৬ জোড়া চোখ আঁকা আছে। এই রথটির প্রথম তলায় শ্রী চৈতন্য লীলা, দ্বিতীয় তলায় শ্রীকৃষ্ণলীলা, তৃতীয় তলায় শ্রী রামলীলা ও চতুর্থ তলায় শ্রী জগন্নাথ দেবের সিংহাসন অবস্থিত। রথের দড়ি দুটির পরিধি ১০ ইঞ্চি , দৈর্ঘ্য ১০০ গজ, ব্রেক হিসেবে ৫০ ফুট কাঠের লম্বা বীম আছে। রথ চালাবার জন্য কাঁসর ঘন্টা বাজানো হয় ও থামাবার জন্য বন্দুক থেকে গুলি ছোড়া হয়। রথের অশ্ব দুটি সম্পূর্ণ তামার- একটি নীল ও একটি সাদা। ইংল্যান্ডের জয় ইঞ্জিনিয়ারিং অশ্ব দুটি তৈরি করে দেয়। সারথি ও রাজহংস দুটি কাঠের তৈরি। শুক্লা দ্বিতীয় তিথিতে রথযাত্রা শুরু হয়। রথের টান শুরু হয় বিকাল ৪ ঘটিকায়। জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম রথে চড়ে মাসির বাড়ি গমন করেন। মাহেশ থেকে মাসির বাড়ির দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার। আট দিন পর জগন্নাথ দেব নিজ মন্দিরে আগমন করেন।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )