
রথযাত্রার ইতিহাস – লুকিয়ে আছে বিশ্বাস
অঙ্কিতা চ্যাটার্জী-:
এই প্রতিবেদন যেদিন দিনের আলোর মুখ দেখবে তার কয়েকদিন পর রথযাত্রা। কিন্তু এই রথযাত্রার পিছনে লুকিয়ে আছে ভক্তদের দীর্ঘদিনের বিশ্বাস।
কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুভদ্রা সূর্য গ্রহণ উপলক্ষ্যে পঞ্চক তীর্থে অবগাহন করতে যান। বৃন্দাবন থেকে ব্রজবাসীরাও এই পূণ্যস্নানে অংশগ্রহণ করেন। শ্রীকৃষ্ণের আগমনের খবর পেয়ে লক্ষ লক্ষ ব্রজবাসী তার দর্শন লাভের আশায় সেখানে হাজির হন। ব্রজের রাখাল প্রেমময় শক্তির আধার শ্রীকৃষ্ণকে ব্রজধামে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্রজবাসীরা রথের রসি ধরে টানতে থাকে। সেই সময়কে স্মরণ করেই শুরু হয়েছে রথযাত্রার উৎসব।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দীর্ঘদিন কেটে গেলেও শ্রীকৃষ্ণ থেকে গেছেন দ্বারকায়। গাছের উপর পা ঝুলিয়ে বসে থাকার সময় তাঁর রাঙা চরণকে টিয়া পাখি ভেবে ভুল করে বাণ মেরে বসে জরা নামে এক শবর। বাণের আঘাতে প্রাণ হারান কৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর খবর পেয়ে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন, গোটা দেহটা পুড়লেও সখার নাভিদেশ পুড়ছে না! তখনই হয় দৈববাণী, ‘ইনিই সেই পরমব্রহ্ম। অর্জুন, এঁকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করো। সমুদ্রেই ওঁর অনন্তশয়ন।’ অর্জুন তাই করলেন। ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম সেই নাভি। তাকে লক্ষ্য করে সমুদ্রের তীর ধরে দ্বারকা থেকে পুরী পর্যন্ত ছুটে চলে শবর জরা। এখানেই ঠাকুরকে স্বপ্ন দেখল সে, ‘কাল ভোরে আমাকে তুলে নে। এখন থেকে তোর বংশধরদের হাতেই পুজো নেব আমি’। তখন থেকে নীলমাধবরূপে তিনি পূজিত হতে থাকেন শবরদের কাছে। সময়টা দ্বাপর যুগ।
কলিযুগে কলিঙ্গের রাজা বিষ্ণু ভক্ত ইন্দ্রদ্যুম্ন জগন্নাথধামে মন্দির গড়ে তুললেও সেখানে ছিলনা বিগ্রহ। রাজা জানতে পারেন বিষ্ণুরই এক রূপ হলেন নীলমাধব। চারদিকে লোক পাঠালেন রাজা। এদিকে বাকিরা ফিরে এলেও ফিরলেন না বিদ্যাপতি। তিনি জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালে তাঁকে উদ্ধার করলেন শবররাজ বিশ্ববসুর সুন্দরী কন্যা ললিতা। তার প্রেমে পড়েন বিদ্যাপতি। বিয়ে হল দুজনের। বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ সকালেই শবররাজ কয়েক ঘণ্টার জন্য উধাও হয়ে যাচ্ছেন। স্ত্রীকে প্রশ্ন করে জানতে পারেন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন জায়গায় নীলমাধবের পুজো করতে যান শবররাজ। বিদ্যাপতি বায়না ধরেন তিনিও দর্শন করবেন নীলমাধবকে। শর্তসাপেক্ষে বিশ্ববসু জামাই বিদ্যাপতিকে চোখ বেঁধে নিয়ে গেলেন। দর্শন পেলেন নীলমাধবের। বনের মধ্যে পূজোর ফুল কুড়িয়ে এনে বিশ্ববসু যখন পুজোয় বসেন অমনি দৈববাণী হল, এতদিন আমি দীন-দুঃখীর পূজো নিয়েছি, এবার আমি মহা-উপাচারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পূজো নিতে চাই।’ খবর পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই গুহার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। তখন দৈববাণী হল যে সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে যে কাঠ সেই কাঠ দিয়ে বানাতে হবে বিগ্রহ। কাঠের একদিক ধরলেন শবররাজ আর একদিক ব্রাহ্মণপুত্র বিদ্যাপতি। মহারাজ তাঁর কারিগরদের মূর্তি গড়ার কাজে লাগালেও সেই কাঠ এমনই পাথরের মত শক্ত যে ছেনি, হাতুড়ি সবই যায় ভেঙে। মহারাজের আকুলতা দেখে স্বয়ং জগন্নাথ বৃদ্ধের বেশে হাজির হন। শর্ত দেন একুশদিন আগে তিনি নিজে দরজা না খুললে কেউ যেন তাঁর ঘরে না আসে। শুরু হল কাজ। চোদ্দদিনের মাথায় কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রাণি মহারাজকে জানাতেই ইন্দ্রদ্যুম্ন খুলে ফেললেন কক্ষের দরজা। ভেতরে দেখেন বৃদ্ধ কারিগর উধাও, পড়ে আছে তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি। তাদের হাত, পা কিছুই গড়া হয় নি। ভেঙে পড়লেন রাজা। স্বপ্ন দিয়ে জগন্নাথ বললেন এটা পুনর্নির্ধারিত ছিল। তিনি এই রূপেই পূজিত হতে চান। সেই থেকেই শ্রী জগন্নাথদেবের মূর্তি ওভাবেই পূজিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
জগন্নাথের প্রধান উৎসব হল রথযাত্রা। আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথদেব বোন সুভদ্রা ও দাদা বলরামকে নিয়ে রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি যান। সেখান থেকে সাতদিন পরে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। এই যাওয়াটাকেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি যাওয়া বলে। রথের দিন তিনটি রথ পর পর যাত্রা করে মাসির বাড়ি। রথে চড়ে এই গমন ও প্রত্যাগমনকে সোজারথ ও উল্টোরথ বলে।