‘আমি’ ‘I’

শম্পা মহান্তি (কলকাতা)

প্রত্যেক বার আমি কেন আগে মানিয়ে নেবো, আমিই কেন আগে কথা বলো। ….. এই ‘আমি’ কে গুরুত্বপূর্ণ করতে গিয়ে মানুষের কতো সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।
‘আমি’ র মধ্যে তৃতীয় মানুষ ঢুকে গেলে তো আর কথা নেই।
কি ভাবছেন হঠাৎ করে ‘আমি’ নিয়ে কেন বলতে শুরু করলাম। আসলে এই সেদিন করেই ওদের দুজনের বিবাহিত জীবনের পথ শুরু হলো। একেবারেই চোখের সামনে, জানালার পর্দা সরালেই, মাঝেমধ্যেই ওদের খুনসুটি হাসি ঠাট্টা চোখে পড়তো। রহিত অনার সদ্য বিয়ে হয়েছে। দুইটি কে বেজায় সুন্দর লাগতো দেখতে। রহিতের অফিসের টিফিন গোছানোর সময়ে, মাকে লুকিয়ে অনার গালে মিষ্টি হামি খাওয়ার দৃশ্য ও একদিন চোখে পড়েছে। সে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরে পরে অনা রেডি হতো অফিসের জন্যে। মাঝেমধ্যেই শাড়ি পরতো গুছিয়ে পিঠ কাটা
ব্লাউজের মধ্যে ছিলো আধুনিকতার নকশা। রোদ চশমার নিচে হাল্কা গোলাপী ঠোঁট। কপালে ছোট টিপ। কি মিষ্টি লাগতো।

আমার তো মেয়ে বাইরে থাকে। কাজের সূত্রে। ওকে দেখলেই আমার নিজের মেয়ের কথাই মনে হতো। তাই প্রতিবেশীকে মাঝেমধ্যেই জানালার ফাঁকে দেখতে পেলে মন্দ লাগতো না।

রাতে ফিরে চায়ের টেবিল থেকে ডিনারের আড্ডা চলতো ওদের। একটু জোরে জোরে হাসতো অনা। রহিতের গিটার বাজানোর শখ ছিলো। এই তো সেদিন করে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে অনা বলছিলো,’এই রবিঠাকুরের একটা গানের টিউন বাজাও তো গিটারে শুনি।’
আমি ঘরের আলো নিভিয়ে জানালার পাশে বসে শুনেছি সে গান। আর মনে মনে ভেবেছি বিয়ের পরে, আমার মেয়ে জামাই বিদেশে থাকলেও যেনো দেশের সংস্কৃতিতে ওদের মতোই ধরে রাখে।

একা থাকতাম তো। এমন কতো কি ভেবেছি আর ওদের দেখে আনন্দ পেয়েছি। সকালে অনা যখন ওদের বাগানের ফুল তুলতো আমি ওকে দেখতাম মন থেকেই আশীর্বাদ আসতো।

আজকের নিয়ে বেশকিছু দিন হলো অনা আর রহিতের কোন সাড়া শব্দ পাই না। কি হলো জিজ্ঞাসা ও করতে পারি না। মনটা ছটফট করে। জানালা খুলি আর বন্ধ করি। সকালে ওদের বাগানটাকে নিজের ছাদ থেকেই দেখি তবুও মেয়েটাকে দেখতে পাই না।
এর মধ্যে সেদিন করে সকালে হাঁটার জন্যে বেরোব কি, পথে রহিতের মায়ের সাথে দেখা হলো। আর মনের উৎকণ্ঠা ধরে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই বসলাম,’দিদি অনা কি ওর বাবার বাড়িতে গেছে। আসলে ওই আর কি দেখতে পাই না মেয়েটাকে। কি সুন্দর লাগে ওদের দুইটিকে। আমার মেয়েরও তো সামনের বছরে বিয়ে দেবো।’….মুখের কথা শেষ না হতেই রহিতের মা বললেন,’ওদের কথা হয় না বহুদিন ধরে। রহিতের অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট কে নিয়ে কি যেন হয়েছে। মেয়েটা অফিসের ট্রিপে গিয়েছিল। তারপরে ফেসবুকে নানারকম ছবি দেয়, সেই থেকে অনা রোহিতের মধ্যে কি হলো আমায়ও কিছুই বলছে না। অনার বাপের বাড়ির লোকজন বলেছে,’অনা আর ফিরবে না।’

আমার শুনে মন টা আকুল হয়ে গেলো। আর কিছুই জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না।

ওর সপ্তাহ দুয়েক পরে আমার মেয়ের ফোন এলো,’বললাম কবে ফিরছিস ঘরে,এবার বিয়ে কর, বুড়ি মায়ের ইচ্ছে পূরণ করবি না মা।’…..উত্তর এলো,’মা এই বেশ ভালো আছি। আমরা অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।’বললাম বেশ তো,তোর কোম্পানির নাম কি রে যেখানে তুই নতুন জয়েন করেছিস?’….’ওয়ালমার্ট।’

শুনে চমকে উঠলাম ওই একই অফিসের ব্রাঞ্চে রোহিতও কাজ করে। ওর তো একটা বিদেশ ট্রিপ হয়ে ছিলো। যার পিক দেখে অনা রোহিতের দূরত্ব ….. সে আমার সোহিনী নয় তো।

সোহিনী তো কোন সম্পর্কে বিশ্বাসী নয়। তাহলে…..তাহলে…..’কথা বলতে না পারাই কি সব শেষ করে দিলো। আবার বেশি ভেবে ফেলছি না তো। সোহিনী কেন হবে,ও তো রহিতের অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট নয়।ওর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় সব প্রশ্ন তুলে নিজের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে রইলাম।

……তাহলে আসলে কি? সত্য বলে সত্যিই কি কিছুই নেই !

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )