রবীন্দ্রনাথ – আজও আমাদের হৃদয়ে

রবীন্দ্রনাথ – আজও আমাদের হৃদয়ে

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী:-  দেশ, কালের সীমায় আটকে না থাকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন বিশ্বের বিরল প্রতিভাধর মহামানব কাব্য জগতে যিনি বিশ্বকবি বা গুরুদেব নামেই পরিচিত। তাঁর সৃষ্টির স্বাদ বিশ্বের প্রতিটি দেশের মানুষ আজও উপভোগ করে চলেছে। বাঙালির মনে-প্রাণে, সুখে-দুঃখে, উৎসবে-ব্যসনে সবেতেই আছেন রবীন্দ্রনাথ। মানব জীবনের সমস্ত ধরনের অনুভূতিবোধ নিয়ে রচনা করেছেন কাব্যগাথা। কোনো কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তিনি হয়ে উঠেছেন বাঙালির আত্মার আত্মা, ঘরের মানুষ। ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’-ও থেকে গেছেন একইরকম প্রাসঙ্গিক। তাঁর জন্মদিন হয়ে উঠেছে জাতীয় উৎসব।

   জমিদার বাড়ির সন্তান ছিলেন তিনি। ভাবা হয়েছিল তিনি হয়তো বিলাস ব্যসনে মত্ত হয়ে উঠবেন। বাস্তবে দেখা গেল তিনি অন্য ধাঁচের মানুষ। জন্মসূত্রে যিনি জমিদার কর্মসূত্রে তিনি সাহিত্যস্রষ্টা। তিন হাজারের মতো কবিতা, দু’হাজারের বেশি গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, অজস্র প্রবন্ধ তিনি রচনা করেছিলেন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীত রচয়িতা, সুরকার, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, সংগীতশিল্পী ও দার্শনিক। এক কথায় বলা চলে- একের মধ্যে বহু।

   রবীন্দ্রনাথ শুধু কাব্য-সাহিত্য সৃষ্টি নিয়ে থেমে থাকেননি। দেশের কাজ, দশের ভালর কথাও ভেবেছেন। তিনি ছিলেন একজন ভ্রমণ রসিক, বিশ্বপর্যটক। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম হওয়ায় তাঁর চিন্তাধারা ছিল সমকালীন অনেকের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। নিছক ভ্রমণের আনন্দ উপভোগ করার জন্য তিনি ভ্রমণ করেননি। যখন যেখানে গেছেন সেখানকার সমস্ত অনুভূতিগুলো মিশিয়ে নিয়েছিলেন নিজের জীবনাদর্শের সঙ্গে এবং প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছিলেন নিজের দেশের মধ্যে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করলেও রাশিয়ার শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা, কৃষি ভাবনা ইত্যাদি তাঁর চিন্তা জগতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং সেই সঙ্গে নতুনভাবে তাঁকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল। সেখানে যা দেখেছিলেন বা শিখেছিলেন সেটাই তিনি এই দেশে প্রয়োগের কথা ভেবেছিলেন।

   রবীন্দ্রনাথ লক্ষ্য করে দেখেছিলেন জার শাসনে অবমাননার অন্ধকারে নিমজ্জিত নিরক্ষর চাষী রুশ বিপ্লবের পর আত্মমর্যাদা ও আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন দেশ গড়ার কাজে মগ্ন হয়েছিল। রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় স্থাপিত হয় কৃষিভবন। নিরক্ষর চাষীরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ আবাদ শেখার সুযোগ পায়। তারপরই তারা কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শুরু করে। কৃষি জমিতে উৎপাদন বাড়ে। কৃষকরা মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাদের মর্যাদা বাড়ে। কৃষিতে শুরু হয় নতুন ধারণা।

    রবীন্দ্রনাথ আরও লক্ষ্য করে দেখেছিলেন রাশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় টুকরো টুকরো জমিগুলো একত্রিত করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে। এরফলে চাষীরা আগের থেকে বেশি ফসল পেত। শুধু তাই নয় কৃষিতে নারীদের যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সেটাও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।

   রবীন্দ্রনাথ জানতেন রাশিয়ার মত ভারতও কৃষিপ্রধান দেশ এবং অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবি। এখানকার কৃষকরাও নিরক্ষর। কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে কৃষিকাজ চলছে মান্ধাতা পদ্ধতিতে। না আছে যন্ত্রের ব্যবহার, না আছে নিরক্ষর কৃষকদের শিক্ষার ব্যবস্থা। সব থাকা সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদন না বাড়লেও কৃষকদের দারিদ্রতা বেড়েছে। 

  তাই হয়তো তিনি চেয়েছিলেন রাশিয়ার মত এদেশেও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হোক। পরাধীন দেশে রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন পূরণ না হলেও এই দেশে ধীরে ধীরে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে। একদিন হয়তো টুকরো টুকরো জমি একত্রিত করে কৃষিকাজ শুরু হবে। শ্রীনিকেতন, কল্যাণীতে স্হাপিত হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষিতে এসেছে নতুন ধারণা। এভাবেই একদিন পূরণ হবে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা।

     চারদেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে নোট মুখস্থ করে ডিগ্রি অর্জন করার মত প্রথাগত শিক্ষায় কোনো দিনই রবীন্দ্রনাথের খুব একটা ভরসা ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষা হলো সজীব মনের তত্ত্ব। শিক্ষা মানুষের মনকে, মনুষ্যত্বকে সম্পূর্ণতা দেয়। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষার শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে তার সম্পূর্ণতার উপর যা প্রতিটি মানুষকে সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলে। তিনি নিজে বিদ্যালয়ে যেতে ভালবাসতেন না। প্রকৃতির কোলে বসে প্রকৃতি থেকেই তিনি শিক্ষা নেওয়ার কথা ভাবতেন। সেই ভাবনারই ফসল শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী। 

   এর মাধ্যমে চারদেওয়ালের চেনা গণ্ডির বাইরে প্রাচীন ভারতীয় গুরুকুলের আদর্শকে তিনি নিয়ে এলেন আধুনিক যুগে। প্রকৃতির কোলে খোলা আকাশের নীচে শিক্ষকের পরিবর্তে গুরুদের সঙ্গে শুরু হলো অন্য ধরনের পড়াশোনা। রবীন্দ্রনাথের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে এলেন কৃতীরা। তাঁদের অধীত জ্ঞান বিতরণ করলেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে। একইসঙ্গে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরাও এখানে জ্ঞানার্জন করতে এল। নিজের অজান্তেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন সকলের গুরুদেব। একশ বছর আগেই প্রথাগত শিক্ষার চেনা ছক ভেঙে তিনিই তৈরি করেছিলেন আধুনিক ভারতের প্রথম আদর্শ গুরুকুল। এই কারণেই আধুনিক শিক্ষা বিজ্ঞানীরা শিক্ষা ক্ষেত্রে আজও তার শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন। 

     রবীন্দ্রনাথ যখন একের পর কালজয়ী সাহিত্য সৃষ্টি করে চলেছেন দেশের তখন  বড় দুঃসময়। ইংরেজ শাসনের শিকলে বন্দী দেশমাতাকে মুক্ত করার জন্য উদগ্রীব একদল বেপরোয়া যুবক দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে কেউ হয়েছে ইংরেজ কারাগারে বন্দী, কেউ দ্বীপান্তরিত অথবা ফাঁসির মঞ্চে হাসতে হাসতে আত্মত্যাগ করেছে। এদের মত সক্রিয় রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথ কোনোদিনও জড়িয়ে না পড়লেও জনসাধারণের কাছ থেকে দূরেও সরে থাকেননি। তাঁর কলমই হয়ে উঠেছিল বিপ্লবের অস্ত্র, আন্দোলনের হাতিয়ার। ইংরেজ সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে গুরুত্ব না দিয়ে লিখে গেছেন দেশভক্তির সুরে গাঁথা ‘গোরা’ বা ‘ঘরে-বাইরে’-র মতো রাজনৈতিক উপন্যাস এবং একই সুরে রচনা করেছেন একের পর এক দেশভক্তির গান। বঙ্গভঙ্গের সময় ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করে লিখেছিলেন “বাংলার মাটি বাংলার জল…”। সব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বাতাবরণ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রবর্তন করেছিলেন ‘রাখি বন্ধন’ উৎসব। জালিয়ানওয়ালাবাগের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইংরেজ সরকারের দেওয়া সর্বোচ্চ অসামরিক খেতাব ‘নাইট’ উপাধি তিনি হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জমিদারি সম্পত্তি রক্ষার তাগিদ থাকলেও দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে তিনি দূরে সরে থাকেননি। বারবার তার লেখনি গর্জে উঠেছে। তাঁর পথ ভিন্ন হলেও দিনের শেষে বিপ্লবীদের মত তাঁরও লক্ষ্য ছিল একটাই – দেশের স্বাধীনতা। 

     বৈষ্ণব পদাবলীর পর বাঙালি তার বিচিত্র প্রেমানুভূতি সবচেয়ে বেশি খুঁজে পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনে এবং কাব্যভুবনে। প্রেমরস আস্বাদনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের যেমন জুড়ি মেলা ভার তেমনি তার ব্যক্তিজীবনের প্রেম রসিকজনের কাছে রসের আধার। তিনি বারে বারে প্রেমে পড়েছেন। সেই প্রেম কখনও তাঁকে দগ্ধ করেছে কখনও আবার প্রেরণা জুগিয়েছে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির। তীব্র কল্পনাপ্রবণতা, সুদূরের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি বাঁধভাঙা আকর্ষণ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁর কাব্যে প্রেম জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তবে এরজন্য তাঁর কাছে নারীর প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হয়নি। তাঁর মতে কাঙ্ক্ষিত নারী যখন কল্পনার অসীম থেকে সংসারের বাস্তব  সীমার মধ্যে চলে আসে তখন প্রেম আর প্রেম থাকে না। তিনি মনে করেন প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাকে ধরা যায় না- “ভালোবাসো,  প্রেমে হও বলী / চেয়ো না তাহারে”। সত্যিই এক অসাধারণ ভাবনা।

     তাঁর গল্প-উপন্যাসের নায়িকারা প্রেমের চেনা পথ ছেড়ে প্রেমের আগুনে পুড়তে গিয়েছিল। রক্ষণশীল সমাজের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে সাহসী প্রেমের যে গল্প তিনি লিখছেন যেখানে প্রেম কোনও নিয়ম তো মানেনি উল্টে নিয়ম ভেঙেছিল। প্রেমের  প্রশ্নে তিনি ছিলেন পুরোপুরি ‘বিশুদ্ধবাদী’। প্রেমের ক্ষেত্রে শরীরকে তিনি বরাবরই গৌণ মনে করতেন। তাঁর মত কামগন্ধহীন প্রেমের সূক্ষ্ম প্রকাশ আর কোনো কবির মধ্যে দেখা যায় না।

     সমাজ বা ব্যক্তি প্রত্যেকেই চেনা পথে হাঁটতে ভালবাসে। চেনা পথ ছেড়ে ছক ভাঙা রাস্তায় হেঁটে কেউই নিজেকে নতুন করে গড়েপিটে নেওয়ার কথা ভাবে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অন্য ধাঁচের মানুষ। কাব্য জগতে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেও নিজেকে অনবরত ভেঙেছেন। আরও কী কী ভাবে নিজের ভাবনার প্রকাশ ঘটানো যায় সেই চেষ্টায় দিনরাত ঘাম ঝরিয়েছেন। তাই তো জীবনের অন্তিম পর্বে পৌঁছে তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন রং-তুলি। তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন মনের ভাবনা। রঙিন হয়ে উঠেছে একের পর এক ক্যানভাস। যেন এক ছক ভাঙার খেলা।

    এই ছক ভাঙার খেলাটা স্পষ্ট বোঝা যায় যখন তিনি নিজের লেখা নাটক নিয়ে  জোড়াসাঁকোর বাড়িতে পরিবারের সকলের সঙ্গে মিলে অভিনয় করতেন। বিসর্জন, ডাকঘর, বাল্মীকি প্রতিভা প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে তিনি কত বড় মাপের অভিনেতা। 

    তিনি ছিলেন, আছেন ও ভবিষ্যতেও থাকবেন আমাদের বড্ড কাছের মানুষ হয়ে। সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, রাগ, অভিমান বোঝানোর জন্য আজও বাঙালি মনকে বারবার তাঁর গানের আশ্রয় নিতে হয়। কালের নিয়মে অন্যদের অস্তিত্ব যখন মানুষের মনে ফিকে হয়ে যাচ্ছে তখন ভিন্নধর্মী জীবনদর্শনের জন্য আজও রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা  এতটুকু নষ্ট হয়নি। পৃথিবীতে যতদিন হিংসা, অশান্তি এবং কাব্যচর্চা থেকে যাবে ততদিনই রবীন্দ্রনাথের বিশ্বশান্তি ও মৈত্রীর আদর্শ, মানবপ্রেম ও কল্যাণের আদর্শ প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে। আগামী দিনেও তিনি চির নতুন থেকে যাবেন।

     ছোট্ট পরিসরে সীমিত শব্দ সংখ্যার মধ্যে এই বিশাল মাপের মানুষটির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা খুবই কঠিন। ছোট গল্পের মত মনে হবে ‘শেষ হয়েও শেষ হয়না’। তবুও একরাশ আক্ষেপ নিয়ে এক সময় থামতে হয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা কখনোই থামবেনা, চলতেই থাকবে।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )