প্রাচীন বৌদ্ধ প্রত্নস্থলটি জনপ্রিয়তা লাভ পাইনি,তিলপি ও ধোসা গ্রাম দুটি

প্রাচীন বৌদ্ধ প্রত্নস্থলটি জনপ্রিয়তা লাভ পাইনি,তিলপি ও ধোসা গ্রাম দুটি

কুতুব উদ্দিন মোল্লা, ক্যানিং:-

দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার জয়নগর থানার অন্তর্গত ধোসা চন্দনেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্যতম ঐতিহাসিক দুটি গ্রাম তিলপি ও ধোসা। এই দুটি গ্রামের চারপাশে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে বেশ কিছু পুরানো কাঠামোর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে ২০০৫ সালে।ধ্বংসাবশেষ গুলো বৌদ্ধ স্থাপত্যের সাক্ষ্য দেয়।
তিলপি গ্রামের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি মানব সভ্যতার তিনটি স্তর বা পর্যায়ের সাক্ষ দেয় । প্রথম সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ২য় থেকে ১ম শতাব্দী এবং দ্বিতীয় সময়কাল ২য় থেকে ৩য় শতাব্দীর কাছাকাছি। তৃতীয় পর্যায়ে ১৬ম থেকে ১৭ম শতাব্দিতে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তিলপিও ধোসা গ্রামে। মনে করা হয় যে দ্বিতীয় পর্ব শেষ হওয়ার পরে।এই এলাকায় মানুষের জনবসতি হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছিল।এখানে পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে জানা যায় যে।খ্রিষ্টীয় ৩য় শতাব্দীর শেষের দিকে এখানে একটি বিশাল অগ্নিকান্ড হয়েছিলো। সেই অগ্নিকান্ডে এই এলাকার জনবসতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছিলো। অথবা পার্শ্ববর্তী এলাকার পিয়ালি নদী এবং বিদ্যাধরি নদীর বন্যা এই প্রাচীন জনবসতিকে ধ্বংস করেছিলো। দির্ঘ বিরতির পরে পরবর্তীতে তৃতীয় পর্যায়ে ১৬ম – ১৭ম শতাব্দীতে আবার তিলপি ও ধোসা এলাকায় মানব সভ্যতার সুচনা হয়েছিল। তিলপি এবং ধোসা গ্রামে খননকার্যের ফলে পাওয়া বেশিরভাগ প্রত্নবস্তু গুলো গুপ্ত যুগের।তিলপি এবং ধোসা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দুটি পিয়ালী নদীর খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই পিয়ালি নদী অতিতে বিদ্যাধরী নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। এখনো পিয়ালি নদী হয়ে বিদ্যাধরী নদিতে যাওয়া যায়। বিদ্যাধরি নদী ধরে আমরা যদি ক্রমশ: উত্তর দিকে একটু উপরের দিকে যাই।তাহলে আমরা চন্দ্রকেতুগড়ে পৌছে যাবো। প্রাচীন ভারতের আরেকটি প্রধান ঐতিহাসিক শহর হচ্ছে এই চন্দ্রকেতুগড়। যেটি উত্তর ২৪ পরগনায় অবস্থিত। ঐতিহাসিকভাবে, চন্দ্রকেতুগড় ছিল একটি প্রধান সমুদ্র বাণিজ্য বন্দর। অতিতে এই পথেই বাংলার সাথে সারা বিশ্বে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল।
বিখ্যাত চীনা বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ফা-হিয়েনের কাছ থেকে তিলপি এবং ধোসা স্থানের কিছু বর্ণনাও পাওয়া যায়। ভারত ভ্রমনের সময় তিনি এই অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন বৌদ্ধ মঠ পরিদর্শন করেছিলেন। ফা হিয়েন বাংলার এই এলাকায় একটি বৃহৎ বৌদ্ধস্তুপ পরিদর্শনের কথা উল্লেখ করেছিলেন।যা মোটামুটিভাবে তিলপি এবং ধোসা গ্রামকে নির্দিষ্ট করে। ধোসার চারপাশে খনন প্রক্রিয়া চলাকালীন, প্রচুর পরিমাণে পোড়ামাটির ইট পাওয়া যায় যা একটি বড় সুনির্মিত কাঠামোর উপস্থিতির কথা বলে।দক্ষিন ২৪ পরগনা জেলার জয়নগর থানা ধোসা চন্দনেশ্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের তিলপি ও ধোসা
গ্রাম দুটি। দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। প্রথম স্থানটি ধোসা অপরটি তিলপি গ্রামের অন্য একটি প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চলে । ধোসার প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি প্রধান সড়কের কাছেই অবস্থিত। উৎ খননের পরে তিলপি, ধোসার প্রত্নতাত্ত্বিক খননগুলি সবই মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। পুরাতাত্ত্বিক গর্ত গুলো মাটি দিয়ে ভরাট করে দিলেও এখনো এখানের মাটিতে পোড়ামাটির ইট এবং অন্যান্য কাঠামোর টুকরো খণ্ড গুলি দেখা যায়। প্রত্নতাত্বিক দৃষ্টিতে দেখলে সহজেই বোঝা যায় এটি এক সময় একটি বিশাল বড় পোড়া ইটের কাঠামো ছিলো।তবে স্থানীয়রা বলেন ২০০৫ ও ২০০৭ সালের মধ্যে এই এলাকায় বেশ বড়সড় খনন কাজ করা হয়েছিল এবং খননকালে প্রত্নতাত্ত্বিক দলটি বেশ সংখ্যক পোড়ামাটির এবং ধাতব বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলো। এই বস্তুগুলি ছাড়া এখানে কোনও কাঠামোর উপস্থিতি দেখা যায়নি।খননের সময় এখানে পাওয়া বস্তুগুলির বেশিরভাগই বেহালার রাজ্য প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরে রাখা আছে।তবে তিলপি গ্রামের প্রত্নক্ষেত্রটি আর এখন গেলে কেউ চিনতে পারবেন না। তিলপি গ্রামে যে দুটি যে অংশে খননকাজ হয়েছিলো সেটিও মাটি দিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। ব্যাক্তিগত মালিকানার শরিকদের মধ্যে প্রত্নক্ষেত্রটি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। প্রত্যেকেই নিজের নিজের অংশে পাচিল তুলে দিয়েছে। বাঁশঝাড়,বন জঙ্গলে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। প্রাচীন যুগের গুরুত্বপূর্ণ একটি জনবসতি এখন আধুনিক মানুষের দখলে। হাজার বছরের ইতিহাস মাটি চাপা পরে কাঁদে।উৎখননের সময় স্থানীয়দের সরকারি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে। এলাকাটিকে একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা হবে। স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়ন হবে। দুর্ভাগ্যবশত।এই ধরণের কিছুই ঘটেনি এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলির কোথাও আর খনন করা হয়নি। তবে স্থানীয়দের দাবি সঠিক পরিকল্পনা এবং সরকারের সদিচ্ছা থাকলে তিলপি এবং ধোসা গ্রামকে কেন্দ্র করে ভালো একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেত। তবে তা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু ওড়িশা এবং বিহারে দেখা পাওয়া বৌদ্ধ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলির মতোন বাংলার প্রাচীন এই বৌদ্ধ প্রত্নস্থলটি জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি তিলপি ও ধোসা গ্রাম দুটি । তবে সেদিকে তাকিয়ে কবে হবে গ্রামবাসীরা।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )