স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম অস্ত্র লুন্ঠনের ১১০ তম বর্ষপূর্তি আমতায়

স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম অস্ত্র লুন্ঠনের ১১০ তম বর্ষপূর্তি আমতায়

অভিজিৎ হাজরা, আমতা, হাওড়া :- ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে দুঃসাহসিক প্রথম অস্ত্র লুন্ঠন হয়েছিল ১৯১৪ সালের ২৬ শে আগষ্ট, যা রডা অস্ত্র লুন্ঠন নামে খ্যাত। এই অস্ত্র লুন্ঠনের মূল কান্ডারী ছিলেন গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার আমতা থানার অন্তর্গত রসপুর গ্ৰামের ভূমিপুত্র শ্রীশচন্দ্র মিত্র ওরফে হাবু মিত্র।রডা অস্ত্র লুন্ঠন ও শ্রীশচন্দ্র মিত্র ইতিহাসে উপেক্ষিত থেকে গেছেন।১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো সরকারই রডা অস্ত্র লুন্ঠন ও শ্রীশচন্দ্র মিত্র কে স্মরণ করে না।শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র নামে কোনো রাস্তার নামকরণ করা হয় নি। ইতিহাসের পাতায় তার কর্মকাণ্ড স্থান পায় নি। কলকাতার মলঙ্গা লেনে শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র একটি স্মৃতিসৌধ আছে। স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র জম্মভিটায় তাঁর স্মৃতিতে তদানীন্তন ইউনিয়ন বোর্ডের সহায়তায় গ্ৰামবাসীরা একটি স্মৃতি বেদী নির্মাণ করেন। বতর্মানে সেই বেদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। বনজঙ্গলে পরিপূর্ণ বাস্তুভিটা ও দখল হয়ে গেছে।১৯৮৩ সালে রসপুর পিপলস্ লাইব্রেরীর উদ্যোগে গঠিত হয় বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি রক্ষা সমিতি।ওই বছরই ২৬ শে আগষ্ট রডা অস্ত্র লুন্ঠন এর ৭০ তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রসপুর পিপলস্ লাইব্রেরীর পাশে শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি স্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। এই টুকু যা। ভারতবর্ষ কে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য বিপ্লবীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন এ অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বিপ্লবীদের হাতে সেই সময় কোনো আধুনিক অস্ত্র না থাকায় বিপ্লবীরা কোনো উদ্দেশ্য ও কর্মকান্ড সফল করতে পারছিল না। বিপ্লবীরা বুঝতে পারেন যে, আধুনিক অস্ত্রে সশস্ত্র বিপ্লব না করলে ভারতবর্ষ কে কোনো দিনই পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করা যাবে না। অস্ত্রের প্রয়োজন! অস্ত্র সংগ্রহ কি ভাবে হবে? বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র।শ্রীশচন্দ্র মিত্র রডা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তিনি নিজেই অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব নেন। ঘটনার দিন ১৯১৪ সালের ২৬ শে আগষ্ট বেলা আড়াইটে কি তিনটা ব্রিটিশ সরকারের অস্ত্র আইন ইন্সপেক্টর পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী তখন লালদীঘির ভিতর তাঁর অনুচরদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত।এ দিকে কাস্টমস হাউস থেকে পূর্ব পরিকল্পনা মতো এক – এক করে ছয় ‘ টি গরুর গাড়ি বোঝাই হল অস্ত্রে।সপ্তম গাড়ির চালক ছিলেন ছদ্মবেশী বিহারবাসী হিন্দুস্তান গাড়োয়ান ‘ কুঞ্জ ‘ (হরিদাস দত্ত)।শ্রীশচন্দ্র মিত্র তাঁর গাড়িতে তুলে দেন বাক্স ভর্তি ৫০ টি মাউজার পিস্তল,৫০টি অতিরিক্ত স্প্রিং এবং ৫০ টি পিস্তলের খাপ ।যে খাপ এর সাহায্যে মাউজার পিস্তল গুলিকে সময় মতো রাইফেলের মতো বড় করে ব্যবহার করা যায়। সেই সাথে তুলে দেন ৫০ রাউন্ড কার্তুজ। ব্যাপারটা পূর্ণচন্দ্র লাহিড়ী খেয়ালই করলেন না। কাস্টমস হাউস থেকে সাতটি গরুর গাড়ি ক্লাইভ স্ট্রিট থেকে লালদীঘির (ডালহৌসি স্কোয়ার) দক্ষিণ দিকে গেলে ‘ ভ্যানিসিটাট রো’ – র সামনে এসে সেখানে পূর্ব পরিকল্পনা মতো উপস্থিত বিপ্লবী সমিতির সদস্যদের কাছে সপ্তম গাড়িটি দিয়ে বাকি ছয় ‘ টি গরুর গাড়ি শ্রীশচন্দ্র মিত্র রডা কোম্পানির গুদামে পৌঁছে দিতে গেলেন।আর বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নি এবং অফিসে ও যায় নি।অস্ত্র লুন্ঠন হওয়ার পাঁচ দিন পর ৩০ শে আগষ্ট র ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় চিরুনি তল্লাশি করলে ও শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র খোঁজ পায় নি। কিছু মাউজার পিস্তল ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ব্রিটিশ পুলিশ উদ্ধার করেছিল গ্ৰেফতার করেছিল বিপ্লবীদের। অনেক মাউজার পিস্তল ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বিপ্লবীদের হাতে চলে গিয়েছিল, সেই গুলি পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। এই মাউজার পিস্তল দিয়ে বিপ্লবীরা বিভিন্ন জায়গায় অর্থ লুঠ করেছিল। সরকারি গুপ্ত বিভাগের পুলিশ কর্মচারী সুরেন বন্দোপাধ্যায় কে গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ ইন্সপেক্টর মধূসূদন চট্টোপাধ্যায় কে গুলি করে। যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন) রডা লুন্ঠনের অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে বালেশ্বরে বুড়িবালামের তীরে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিলেন।বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত,বাদল গুপ্ত রাইটার্স বিল্ডিং অভিযান করেছিলেন এই লুন্ঠিত মাউজার পিস্তল নিয়ে। ইউরোপিয়ান অ্যাসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট ভিলিয়ার্স কে মাউজার পিস্তলের গুলি করেন।রডা অস্ত্র লুঠের একটি মাউজার পিস্তল ব্যবহার করতেন রাসবিহারী বসু।রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠনের পর অনুষ্ঠিত ৫৪ টি ডাকাতি, নরহত্যা, নরহত্যার চেষ্টায় ব্যবহার হয়েছিল লুন্ঠিত মাউজার পিস্তল। সেই অস্ত্র লুন্ঠনের মূল কান্ডারী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র এর জন্য বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব পান নি। সরকারিভাবে স্মরণ করা হয় না রডা অস্ত্র লুন্ঠনের দিন। ২০২৪ এর ২৬ শে আগষ্ট রডা অস্ত্র লুন্ঠনের ১১০ তম বর্ষপূর্তি পালন হল শুধুমাত্র গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার আমতায়।এ দিন সকালে প্রথম অনুষ্ঠান টি হল রসপুর পিপলস্ লাইব্রেরীর পাশে শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি স্তম্ভের পাদদেশে। দিনটি পালিত হল বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্মৃতি রক্ষা সমিতি -র উদ্যোগে।শ্রীশচন্দ্র মিত্র স্মৃতি রক্ষা সমিতির সম্পাদক অসীম কুমার মিত্র আক্ষেপের সুরে বলেন,রাজ্য, জেলা,ব্লক,গ্ৰাম পঞ্চায়েত স্তরে আজ ও উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়ে রয়েছে শ্রীশচন্দ্র মিত্র। সরকারের কাছে আমাদের দাবি স্বাধীনতা সংগ্ৰামী শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র অবদান ছড়িয়ে পড়ুক সারা বাংলা তথা সারা ভারতবর্ষে। সংরক্ষণ ও দখল মুক্ত করা হোক শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র জম্মভিটা। রসপুর পিপলস্ লাইব্রেরীর সামনে ১৯৮৩ সালে নির্মিত শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র স্মৃতি স্তম্ভের সংস্কার করা হোক। পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হোক শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র জীবনী ও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান। আমতা থেকে বালিচক পর্যন্ত রাস্তার নামকরণ করা হোক শ্রীশচন্দ্র মিত্র সরণী। কবি, আঞ্চলিক লোক সংস্কৃতির গবেষক ও লেখক চন্দ্রাদিত চন্দ্র আক্ষেপের সুরে বলেন আমতা – হাওড়া রেল পথের একটি স্টেশনের নাম রামকৃষ্ণের চিকিৎসক হাওড়া জেলা নিবাসী মহেন্দ্রলাল সরকার এর নামে মহেন্দ্রলাল নগর নামাঙ্কিত করা হয়েছে। আমতা রেল স্টেশনের নাম ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম অস্ত্র লুন্ঠন রডা অস্ত্র লুন্ঠনের মূল কান্ডারী রসপুর গ্ৰাম নিবাসী শ্রীশচন্দ্র (হাবু) মিত্র স্টেশন নামাঙ্কিত করা হোক। এই দিন দ্বিতীয় অনুষ্ঠান পালন করল গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার আমতা ১ নং পঞ্চায়েত সমিতির সিরাজবাটি চক্রের অন্তর্গত আওড়গাছি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাওড়া জেলা ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্রের সম্পাদক তথা গাজীপুর থাকময়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সায়ন দে, আওড়গাছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌমেন মন্ডল প্রমুখ।সায়ন দে এই অনুষ্ঠানে ছাত্র -ছাত্রীদের কাছে গল্পের ছলে শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র কর্ম জীবন,অস্ত্র লুন্ঠনের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেন। এই বক্তব্য কে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয় ক্যুইজ। এই ক্যুইজে ছাত্র -ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে। আওড়গাছি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর প্রধান শিক্ষক তথা পরিবেশ কর্মী,গ্ৰীনচেন মুভমেন্ট সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং ইতিহাস গবেষক ও লেখক প্রদীপ রঞ্জন রীত বলেন, আমতার রসপুরের হাবু মিত্র -র জন্য আমরা গর্বিত।অস্ত্র লুন্ঠনের পর তিনি ব্রিটিশ পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য আসামে রংপুরে আত্নগোপন করেছিলেন। তারপর তাঁর কি পরিণতি হয়েছিল তা আজ ও অজানা।যেমন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর পরিণতি আজ ও অজানা। বিপ্লবী হাবু মিত্র – র আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কথা নতুন প্রজন্ম, স্কুলের কচি কাঁচা পড়ুয়াদের জানানোর জন্য আমরা বিদ্যালয়ে এই দিনটি পালন করার উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন সরকারি পাঠ্যপুস্তকে শ্রীশ মিত্রের জীবনী – কর্মকাণ্ড – র কথা স্থান দেওয়া হোক। আমতা বাসস্ট্যান্ডের নামকরণ শ্রীশচন্দ্র মিত্র -র নামে করা হোক। আগামী বৎসর এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদায় আমতা বাসস্ট্যান্ডে করার পরিকল্পনা করছেন বলে তিনি জানান। আজকের অনুষ্ঠানে বর্ষণমুখর পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে ছাত্র -ছাত্রীদের উপস্থিতি ছিল যথেষ্ট প্রশংসনীয়। উল্লেখ্য এই বিদ্যালয়ে ১৪ ই আগস্ট থেকে ১৮ ই আগস্ট কচি কাঁচা পড়ুয়া, অভিভাবক -অভিভাবিকাদের স্বাধীনতা সংগ্ৰামে আমতা -বাগনান এলাকার মানুষদের কি ভূমিকা ছিল তাই ছবিতে তথ্যের মাধ্যমে প্রদর্শনীতে তুলে ধরা হয়।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )