একাকিত্ব

স্বপ্না চ্যাটার্জী (কলকাতা)

 ইংরেজিতে "লোনলি-নেস", হিন্দিতে "তানহায়ি" ও বাংলায় "একাকিত্ব" এই তিনটি প্রায় সমার্থক শব্দ। তিনটি শব্দই অত্যন্ত গভীর ও অন্তর্মুখী। "একাকীত্ব" এমন একটি শব্দ, যার মধ্যে রয়েছে একা থাকার প্রবণতা, যা সবকিছুর মধ্যে থেকেও সবকিছু থেকে নিজেকে আড়াল করে। 

    "একাকিত্ব" এমন এক গহন অনুভূতি, যা স্বতন্ত্র ও যার নিজস্ব একটা স্বাতন্ত্রতা আছে। আমরা প্রতিটি মানুষ আমাদের কর্মব্যস্ত জীবনে ,যখন অত্যন্ত হাঁপিয়ে উঠি ,তখন মাঝে মাঝে মনে হয়, এই শব্দ মুখর পৃথিবী ছেড়ে যদি কিছুক্ষণ নিজেকে একটু আলাদা করে সময় দেওয়া যেত, যদি মনের মুখোমুখি দুদণ্ড বসা যেত, অথবা যদি একান্তে বসে বড়ে গোলাম আলীর গজলের সুরে সুরে নিজেকে খুঁজে পেতাম, তবে বেশ হতো। কিন্তু সংসার আমাদের সেই সুযোগ দেয় কৈ? আমাদের প্রত্যেকের মাঝে মাঝে এই যে একা থাকার ইচ্ছা আমি এর নাম দিয়েছি "শখের একাকিত্ব।"

  প্রকৃত "একাকিত্ব" ও "শখের একাকিত্"-র মধ্যে পার্থক্য করতে গেলে, প্রকৃত একাকিত্বের বহুবিধ কারণ সম্পর্কে আমাদের অবগত হতে হবে। তাই হাত বাড়ালেই যে দু'চারটে কারণ একাকিত্বের জন্য দায়ী বলে মনে হয় তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। 

 বর্তমানে, প্রতিটি মানুষের চেনা পৃথিবীটা ক্রমশ ছোট হতে হতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। জীবনের শুরু থেকে আমরা যাদের সঙ্গে পথ হেঁটেছি সেই সব মানুষেরা যখন আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যান তখন আমাদের মধ্যে একটা শূন্যতা বা হাহাকার বিরাজ করে। শুধু তাই নয় আপন জনের হারানোর বেদনা মনে গভীরভাবে আঁচড় কাটে। বিশেষ করে সমবয়সী বন্ধুবান্ধব তারা যখন আমাদের হাত ছেড়ে বিদায় নেয় তখন  নিজের জগৎটা  অত্যন্ত টলোমলো হয়ে উঠে। কারণ বেদনার অনুভূতি অত্যন্ত ব্যক্তিগত। কাউকে বোঝানোর নয়। আমরা যখন অত্যন্ত আঘাত পাই তখন আমাদের আঘাতটাকে আমাদের মত করে আর কেউ বোঝেনা। ফলে আমাদের অন্তর মহলে একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়। এই শূন্যতা আমাদের প্রতিনিয়ত নিঃসঙ্গ করে তোলে।  

  এছাড়াও বর্তমানে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আমাদের মধ্যে যে বৈষম্যের প্রাচীর গড়ে তোলে  তাও আমাদের একাকিত্বের অন্যতম কারণ। শুধু তাই নয়, আজকের সমাজে প্রতিটি মানুষের নির্দয়তা, নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতা  আমাদের স্বাভাবিক চেতনাকে ক্রমশ গ্রাস করে। এছাড়াও আমাদের সংসারের থেকে আমাদের যা প্রত্যাশা যখন তা পূর্ণ হয় না তখনও আমরা প্রাত্যহিক চলার সাথে তাল মেলাতে পারি না।ফলে চলমান সংসার থেকে কিছুটা মুখ ঘুরিয়ে চলতে পছন্দ করি।  

 তবে একাকীত্ব যে শুধু পারিপার্শ্বিক কারণের জন্য ঘটে থাকে তা কিন্তু নয়। আমার মনে হয় আমরা নিজেরাও আমাদের একাকিত্বের জন্য অনেকাংশে দায়ী। কারণ আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা অত্যন্ত আত্ম-অহংকারী। তারা মনে করেন তাদের কথাই সংসারের শেষ কথা। তারা নিজেদের মতামত অন্যের উপর চাপাতে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু যখন তাদের এই অটল বিশ্বাসে কেউ আঘাত হানে তখন তারা পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন না। ফলে তারা তাদের চিরপরিচিত সংসারের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের একটা আলাদা পৃথিবী তৈরি করেন। দীর্ঘদিন এই একাকিত্বের মধ্যে থাকতে থাকতে সেখানে প্রাণের কোন নতুন জোয়ার না থাকায় তাদের নিঃসঙ্গ জীবনে স্থবিরতা এনে দেয়।

      তাই "একাকিত্ব" শুধু একটি শব্দ মাত্র নয় এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক একটি অনুভূতি। "একাকিত্ব" মানে গহীন  নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা। "একাকীত্ব" মানে ,চলমান জীবনের বিপরীতে সন্তরণ। "একাকিত্ব" হল বেঁচে থেকেও যেন এক জীবন মৃত অবস্থা। "একাকিত্ব" হলো, অবুঝ মনের অশান্ত বারিধারা। "একাকীত্ব" অনেকটা শামুকের খোলসের মত নিজের চারপাশে, একটা শক্ত আবরন সৃষ্টি করে তার ভেতরে আত্মগোপন করা। একাকীত্ব হলো সংসারে থেকেও, এক নির্জন দ্বীপে নিজের নির্বাসন।
CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )