অনাথ

মালবিকা পণ্ডা (ডিরোজিওনগর, পশ্চিম মেদিনীপুর)

 ফেসবুকে পরিচয় হবার পর থেকেই অপূর্ব ওরফে অপু সঞ্চিতাকে দিদি বলে সম্বোধন করে । সঞ্চিতাও দিদি ডাক শুনে অপুকে আরও অনেক কাছের করে নেয়। অপুর দিদি বা বোন নেই আবার সঞ্চিতার দাদা বা ভাই নেই । স্বভাবতই দুজন দুজনকে পেয়ে খুব খুশি ‌। অপু সঞ্চিতাকে কখনও মিষ্টি দিদি কখনও কখনও আবার মিষ্টি সোনা দিদি বলেও ডাকে। 

    ভাইফোঁটার দিন একটা অনাথ আশ্রমে প্রতি বছর সঞ্চিতা অনাথ বাচ্চাদের জন্য কিছু উপহার নিয়ে যায় । এই বছরও গেছে। বাচ্চারাও অপেক্ষা করে থাকে সঞ্চিতার জন্য। অপুও যায় সেখানে অনাথ বোনদের হাতে ফোঁটা নেবার জন্য। কিন্তু সঞ্চিতার সঙ্গে দেখা কখনও হয় নি। তাহলে ছবি দেখে হয় তো চিনে যেত সঞ্চিতা। 

  এই প্রথম অনাথ আশ্রমে তাদের মুখোমুখি দেখা হয় । সঞ্চিতা দেখতে পেয়ে বলে "তুমি অপু" তাই তো ! 

—হ্যাঁ দিদি আমিই অপু। আমিও তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছি দিদি । কিন্তু তুমি এখানে কেন ?

সঞ্চিতা বলে ,”আমি প্রতি বছর এখানে আসি। এই শিশু গুলোকে ফোঁটা দিতে । ওরাও আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে।”

---আমিও তো আসি দিদি প্রতি বছর । অনাথ মেয়েগুলোর কাছে ফোঁটা নিতে। আমার খুব ভালো লাগে এই একটা দিন আমি ওদের সঙ্গে হৈ হৈ করে কাটাই। 

  তারপর সঞ্চিতা আর অপুর মধ্যে অনেক কথাবার্তা হয়। যেগুলো ফোনে তারা কখনও বলতে পারে নি , সেই সব কথা কাছে পেয়ে উগরে দিল। অপুর কথায় অবাক হয়ে গেল সঞ্চিতা। কি মিল তাদের দুজনের মধ্যে ! অপুকে এই অনাথ আশ্রম থেকে তার বাবা মা নিয়ে গেছে । আর সঞ্চিতাকেও এখান থেকে নিয়ে গেছে তার বাবা মা। অপুও অবাক হয়ে বলে ,"দিদি তুমিও আমার মতো অনাথ।" তারপর দুই ভাইবোন মিলে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটায়। 

  বিকেলে বাড়ি ফেরার সময় একটা ট্যাক্সি এসে ধাক্কা মারে সঞ্চিতাকে। সবাই তুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করল হসপিটালে। অপুর একটা পরিচিতি আছে। অনাথ আশ্রমে দান খয়রাতি করে বলে অনেকেই চেনে। 

  অপু ডাক্তারদের কাছে গিয়ে বলে ," দিদিকে বাঁচিয়ে দেন ডাক্তারবাবু। টাকা পয়সা নিয়ে ভাববেন না। সঞ্চিতার রক্ত লাগবে । এই মূহুর্তে ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই। এই কথা শুনে অপু নিজেই রক্ত দিতে রাজি হল। অদ্ভুত ভাবে মিলেও গেল । কয়েকদিন পরে ডাক্তার এসে অপুকে বলে ,"ঐ মহিলা আপনার কে হন ?" 

 আমার রক্তের সম্পর্ক নেই ডাক্তার বাবু। আমি দিদি বলি ওনাকে। ফেসবুকে পরিচয় । আমাকে খুব স্নেহ করেন। নিজের ভাইয়ের মতো । কেন ডাক্তার বাবু? এখন এই কথা জানতে চাইছেন কেন?

  আপনার সঙ্গে ওনার একটা রক্তের সম্পর্ক আছে। আমরা পরীক্ষা করে এমন কিছু নমুনা পেয়েছি। কনফার্ম করার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠিয়েছিলাম। ওই ভদ্রমহিলা আপনার আপন দিদি। 

 অপু ডাক্তারের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে ,"আপনি ঠিক বলছেন তো! তার মানে আমি "অনাথ" নই। এই পৃথিবীতে নিজের কেউ আছে এই বলেই সে চলে সঞ্চিতার কেবিনের দিকে। মুখে হাসি আর চোখে জল নিয়ে সঞ্চিতার হাতটা ধরে বলে,"দিদি তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো। তুমি আমার আপন দিদি। রক্ত মিথ্যে কথা বলে না দিদি। আজ ডাক্তার বাবু বলেছেন। আমি তোমার নিজের ভাই। আমরা আর ফেসবুকের ভাইবোন নই দিদি। একেবারে নিজের ভাইবোন। আমি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠো দিদি। 

—-“উনি এখন কিছু শুনতে পাবেন না। ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। পরে সব বলবেন আপনার দিদিকে “। একজন নার্স এসে অপুকে বলে গেল।

পরের দিন থেকে সঞ্চিতার অবস্থার অবনতি শুরু হয়। ডাক্তার আপ্রাণ চেষ্টা করে সঞ্চিতা কে সুস্থ করতে পারলো না। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সঞ্চিতা চলে গেল। অপু দিদির হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে ," এত বড় একটা সত্যি তুই শুনে যেতে পারলি না দিদি।" আমি সত্যিই আবার "অনাথ" হয়ে গেলাম দিদি। তোর সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হতো।" 

অপু এখন ফেসবুকে দিদির ছবির সঙ্গে কথা বলে , যেমন বলতো আগে। শুধু লিখে ভাই বলে ডাকার মতো আজ আর কেউ নেই।
CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )