
আসানসোলের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদকে বহিস্কার করলো সিপিএম
কৌশিক মুখার্জী: আসানসোল:-
আসানসোলের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ ও দলের প্রবীণ নেতা বংশগোপাল চৌধুরীকে ঘিরে একটি অভিযোগ রাজ্য রাজনীতিতে তুমুল আলোড়ন তুলেছে। মুর্শিদাবাদের এক সিপিএম নেত্রীর অভিযোগ, বংশগোপাল সামাজিক মাধ্যমে তাঁকে অশালীন ও অশোভন বার্তা পাঠিয়েছেন, যা ‘ভার্চুয়াল যৌন হেনস্থা’র পর্যায়ে পড়ে। এই অভিযোগের জেরে সিপিএম কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সদর দফতর থেকে বংশগোপালকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা করেছে। তবে, আসানসোলের রাজনৈতিক মহলে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি ভিন্ন গুঞ্জন ছড়িয়েছে—এর পিছনে কি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা ষড়যন্ত্র কাজ করছে?এই ঘটনার গোড়া পাওয়া যায় গত ফেব্রুয়ারিতে, হুগলির ডানকুনিতে সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের সময়। সেখান থেকে গুঞ্জন ছড়াতে শুরু করে, যা কয়েক মাসের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগকারিণী, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর, জানিয়েছেন, “একটি সাংগঠনিক বিষয়ে তথ্য দেওয়ার কথা বলে বংশগোপাল আমার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি ফেসবুক মেসেঞ্জারে অশোভন বার্তা পাঠাতে শুরু করেন।” তিনি আরও বলেন, “দলের মুখপত্রের সঙ্গে কাজের সুবাদে আমি তাঁকে হোয়াটসঅ্যাপে আমার নম্বর দিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও তিনি একই ধরনের অগ্রহণযোগ্য বার্তা পাঠিয়েছেন।”
গত নভেম্বরে অভিযোগকারিণী মুর্শিদাবাদ জেলা সিপিএম নেতৃত্বের কাছে এই বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জানান। দলের অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি বিষয়টি নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করে বংশগোপালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার সুপারিশ করে। গত রবিবার, বামেদের ব্রিগেড সমাবেশের পর সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত কথিত স্ক্রিনশট ও অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়ে। তবে, এই উপাদান গুলির সত্যতা এখনও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।সিপিএমের এক শীর্ষ নেতা এই ঘটনায় দলের অবস্থান স্পষ্ট করে বলেন, “আমরা কখনও এ ধরনের অনৈতিক আচরণকে প্রশ্রয় দিইনি এবং ভবিষ্যতেও দেব না। দলের নীতি ও মর্যাদা আমাদের কাছে সর্বোচ্চ।” তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, “এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা পরে অন্য রাজনৈতিক দলের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারেন, যা আমাদের জন্য চিন্তার বিষয়।” সিপিএম জানিয়েছে, বংশ গোপালের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে শীঘ্রই আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।আসানসোল, যেখানে বংশগোপাল চৌধুরী দীর্ঘদিন সাংসদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং স্থানীয় রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছেন, সেখানে এই ঘটনা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন সিপিএম কর্মী, যারা বংশগোপালের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন বা তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন, এই অভিযোগের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, “বংশবাবু এমন কাজ কখনও করতে পারেন না। এটি দলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফল। তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁসানো হয়েছে।” কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এই সিদ্ধান্ত দলের জন্য দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিকর হতে পারে। তাঁরা বলছেন, “এর পিছনের আসল সত্য আগামী দিনে প্রকাশ্যে আসবে।”এই ঘটনায় বংশগোপাল চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি কোনও সাড়া দেননি। ফলে তাঁর বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর নীরবতা এই ঘটনাকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে।
সিপিএমের এই কঠোর পদক্ষেপ তাদের নৈতিক অবস্থান ও অনৈতিক আচরণের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতির প্রতিফলন। তবে, আসানসোলের কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া গুঞ্জন এই ঘটনাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এটি কেবল একটি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ, সামাজিক মাধ্যমের দায়িত্বশীল ব্যবহার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের নৈতিক দায়বদ্ধতা নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে। একই সঙ্গে, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনা এই ঘটনাকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সময়ই বলবে, এই ঘটনার পিছনের পূর্ণ সত্য কী এবং এটি সিপিএমের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর কী প্রভাব ফেলবে। তবে, এই ঘটনা সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বশীল ভূমিকার গুরুত্ব আরও একবার সামনে এনেছে। সিপিএমের এই সিদ্ধান্ত হয়তো নৈতিকতার জয়ের প্রতীক, কিন্তু আসানসোলের গুঞ্জন এই জয়ের পিছনে একটি প্রশ্নচিহ্ন রেখে দিয়েছে।