
আসানসোলে অবৈধ অস্ত্রের জাল: কতটা নিরাপদ এই শহর?
কৌশিক মুখার্জী: আসানসোল:-
পশ্চিমবঙ্গের শিল্পাঞ্চল আসানসোল কি অবৈধ অস্ত্র পাচারের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠছে? এই প্রশ্নই এখন ঘুরছে সকলের মনে, যখন রাজ্য পুলিশের বিশেষ টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) বিহারের মুঙ্গের থেকে আসানসোলে অস্ত্র সরবরাহ করতে আসা কুখ্যাত পাচারকারী মহম্মদ ফিরদৌস আলম ওরফে লাড্ডুকে গ্রেফতার করেছে। তার কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ, যা এই অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে।
শুক্রবার (৩০ মে) বিকালে গোপন সূত্রের খবরের ভিত্তিতে এসটিএফ-এর একটি দল আসানসোলের গৌরান্ডি রোডের কাছে এইচপি পেট্রোল পাম্পের সন্নিকটে অভিযান চালায়। রাত প্রায় ১১:৪৫ নাগাদ একটি বাস থেকে নামা এক ব্যক্তির গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে তাকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। তার ব্যাগ তল্লাশি করে উদ্ধার হয় দুটি ৯ মিমি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, দুটি ৭ মিমি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি একক শট পাইপগান এবং ১৪টি তাজা কার্তুজ। ধৃত ব্যক্তি নিজেকে মুঙ্গেরের মফসসল থানা এলাকার মির্জাপুর ওয়ার্ধা গ্রামের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেয়। আসানসোল উত্তর থানায় অস্ত্র আইনের বিভিন্ন ধারায় মামলা (কেস নং ২৪১/২৫) রুজু করে তাকে ১৪ দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠানো হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে ফিরদৌস আলম চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে। সে জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে সে আন্তঃরাজ্য অস্ত্র পাচার চক্রের সঙ্গে যুক্ত। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে সে। এই চক্র অর্থের বিনিময়ে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো ধরনের অস্ত্র পৌঁছে দেয়। এই তথ্যের ভিত্তিতে এসটিএফ এখন গভীর তদন্ত শুরু করেছে, যাতে জানা যায় আসানসোলসহ রাজ্যের কোন কোন এলাকায় এই অস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত।এই ঘটনার মাত্র একদিন আগে, ধানবাদের কাছে একটি অবৈধ অস্ত্র কারখানার সন্ধান পায় পশ্চিমবঙ্গের এসটিএফ এবং ঝাড়খণ্ডের এটিএস। সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের পাশাপাশি পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে চারজনই মুঙ্গেরের বাসিন্দা। উল্লেখ্য, কুলটির ডিশেরগড়ের বাসিন্দা আশ মহম্মদ ওই কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ করতো। এই ঘটনাগুলো আসানসোলকে অবৈধ অস্ত্র পাচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করছে।
•আসানসোল কি অবৈধ অস্ত্রের ফ্রিজোন?•
বারবার অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং পাচারকারীদের গ্রেফতারের ঘটনা আসানসোলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে। এই শিল্পাঞ্চল কি অপরাধী চক্রের কাছে অস্ত্র পাচারের নিরাপদ ঘাঁটি হয়ে উঠেছে? কত পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র এখনো শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে আছে, তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে অবৈধ অস্ত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় এই পাচার চক্রের কার্যকলাপ আরও তীব্র হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পুলিশের তৎপরতা সত্ত্বেও, এই চক্রের বিস্তৃতি রোধ করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আসানসোলের ভৌগোলিক অবস্থান, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের সীমান্তের নৈকট্য এবং সুবিধাজনক যোগাযোগ ব্যবস্থা এই অঞ্চলকে পাচারকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। তবে, পুলিশের সাম্প্রতিক সাফল্য এই অপরাধী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার ইঙ্গিত দেয়।
•ভবিষ্যৎ কী?•
আসানসোল কি শুধুই একটি ট্রানজিট পয়েন্ট, নাকি এখানে অবৈধ অস্ত্রের একটি বড় সঞ্চয় রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পুলিশের তদন্ত এখনও চলছে। তবে, ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এই অবৈধ অস্ত্রের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ মানুষের মনে এখন একটাই প্রশ্ন—আসানসোল কতটা নিরাপদ?
পুলিশের তৎপরতা এবং গোয়েন্দা তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও, এই অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও কঠোর পদক্ষেপ এবং আন্তঃরাজ্য সমন্বয়ের প্রয়োজন। আসানসোলের মানুষ এখন চায়, তাদের শহর যেন অপরাধের কালো ছায়া থেকে মুক্ত হয় এবং শান্তির আলোয় নতুন দিনের সূচনা হয়।