
পণপ্রথার শিকার, অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে আত্মহত্যা মেমারিতে
নিজস্ব সংবাদদাতা, মেমারি:- রামায়ণ-মহাভারতের কালে নানাভাবে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে মেয়েদের। ফেলতে হয়েছে চোখের জল। লড়াই করে কেউ হয়েছেন সফল। কেউ ব্যর্থ। মিশে গেছেন মাটিতে। বদলেছে সময়। আধুনিক হয়েছে সমাজ। তবে নারীদের ক্ষেত্রে সেই ধারার বদল ঘটেনি। এর পিছনে রয়েছে বিচিত্র সব কারণ। দেশের বিভিন্ন গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। শহরের অবস্থাও যে আশাব্যাঞ্জক, তা কিন্তু নয়। অতীত দিনের মতো এখনও নারীদের মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে পেরোতে হয় নানারকম বাধার পাহাড়। প্রতিনিয়ত চালিয়ে যেতে হয় লড়াই । জন্মের পর আদর করে বাবা-মা নাম দিয়েছিল মামন। পূর্ব বর্ধমান জেলার মেমারি থানার অন্তর্গত বড় পলাশনের বাসিন্দা আসফাদুল হোসেন খান ও কাকলী খানের কন্যা মামন খান বাড়িতে বাবা, মা ভাইয়ের সংসারে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিল পড়াশুনায় মেধাবী মেয়েটা। এদিকে মেয়ে ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ায়,বাবা-মা মেয়েকে ভাল পাত্রস্থ করার জন্য সম্বন্ধ দেখতে লাগলেন। ইতিমধ্যেই একটা সম্বন্ধ এলো । পূর্ববর্ধমানের খন্ডঘোষ ব্লকের মুন্সী সাজেদুর রহিমের (সামীম) সাথে ধুমধাম করেই মামনের বিবাহ হয়। শত অভাবের মাঝেও ছেলের বাড়ির দাবি মত মেয়েকে পাত্রস্থ করলেন বাবা। প্রথম কয়েক মাস ভালই কেটেছিল মামনের। কিন্তু আস্তে আস্তে শ্বশুরবাড়ির আসল রূপ বেরিয়ে পড়ল। বউ সুন্দরী নয়,গায়ের রং কালো বলে শুনতে হচ্ছিল গঞ্জনা। ইতিমধ্যেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে মামন। একদিকে দেখতে কুৎসিত বলে মানসিক নির্যাতন অপরদিকে নতুন করে শুরু হয় পণের জন্য শারীরিক নির্যাতন। সাঁড়াশি আক্রমণে একেবারে ভেঙে পড়ে মেয়েটা । খবর পেয়ে আধমরা মেয়েটাকে নিয়ে চলে আসে তার বাবা মা। এরই মাঝে একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় সে। ২ মে জন্ম নেওয়া কন্যার নাম দেওয়া হয় সুহানা পারভিন। বয়স মাত্র ২ মাস। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে কন্যা সন্তান নয় তারা বংশ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পুত্র সন্তানের আশা করেছিল। যেন কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়াটাও মামনের অপরাধ! এদিকে জামাই বাবাজীবন শ্বশুর বাড়ি এসে পণের জন্য বারে বারে চাপ সৃষ্টি করতে থাকে, সেই সাথে কন্যা সন্তান হওয়ায় মানসিক নির্যাতন তো ছিলই। কিন্তু অভাবের সংসারে জামাইয়ের সাধ পূরণ করার সামর্থ্য ছিল না বাবার , যেটা মামন ভালো করেই জানতো। মামন নিজেকে অপরাধী মনে করতে থাকে, কেন মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করল! কেনই বা তার কোল আলো করে কন্যা সন্তান এলো। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গত সোমবার ৮ জুলাই সে নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। পরিবারের লোকজন দগ্ধ মামনকে বর্ধমান হাসপাতালে ভর্তি করলে মঙ্গলবার ৯ জুলাই মামন মারা যায়। বুধবার মামনের পার্থিব দেহ, তার জন্মভূমিতে কবরস্থ করা হলো। কিন্তু মামন মারা গিয়ে, জন্ম দিয়ে গেছে হাজার প্রশ্নের। কালো বলে গঞ্জনা কিংবা পণপ্রথা যে এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও বহাল তবিয়াতে রয়েছে, তা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল মামনের মৃত্যু। আজও কী পুত্র সন্তানই বংশের ধারক বাহক? কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়া কী অপরাধ? মামনের অপরাধীরা কি শাস্তি পাবে আদৌ? আর দু মাসের সুহানার কী হবে? সে তো মা বলে ডাকতেই পারলো না। আর কত মামন এইভাবে কলি থেকে ঝরে পড়বে! প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। শেষে আশাপূর্ণা দেবীর সাড়াজাগানো উপন্যাস ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছুঁয়ে আজও, এই তথাকথিত আল্ট্রামর্ডান যুগেও যখন মেয়েদের সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা ভাবতে বসি তখন তল খুঁজে পাই না। পৃথিবীটা মেয়েদের জন্য প্রকৃত বাসযোগ্য হয়ে উঠবে কবে?