মুর্শিদাবাদে পৌষমাসের শুরুতে কান্দীর দোহালিয়া দক্ষিণাকালী মন্দির, বহরমপুরের বিষ্ণুপুর কালীমন্দির ও নবগ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে ভিড় পৌষ মাসব্যাপী পুজো ও পৌষমেলা শুরু

মুর্শিদাবাদে পৌষমাসের শুরুতে কান্দীর দোহালিয়া দক্ষিণাকালী মন্দির, বহরমপুরের বিষ্ণুপুর কালীমন্দির ও নবগ্রামের কিরীটেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে ভিড় পৌষ মাসব্যাপী পুজো ও পৌষমেলা শুরু

রাজেন্দ্র নাথ দত্ত:মুর্শিদাবাদ:-


পৌষের প্রথমদিন থেকেই মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দীর দোহালিয়া দক্ষিণাকালী মন্দিরে ভিড় উপচে পড়ল লাইন দিয়ে পুজো দিলেন বাসিন্দারা। বুধবার সকাল থেকেই দোহালিয়া গ্রামের বাসিন্দারা দেবীকে মুলো ও সর্ষের গাছ সমর্পণ করলেন। মন্দির চত্বরে শুরু হয়েছে পৌষমেলা। ভক্তদের নিরাপত্তার জন্য মন্দির কমিটি বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়েছে।বহু প্রাচীন এই মন্দিরের সঙ্গে বাংলার রাজা বল্লাল সেন ও লক্ষ্মণ সেনের নাম জড়িত। ব্যাঘ্ররূপী দক্ষিণাকালীর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার এই দুই রাজার নাম। সারা বছরই মন্দিরে দেবীর পুজো দিতে আসেন স্থানীয় বাসিন্দা সহ ভিনজেলা এমনকী ভিনরাজ্যের অনেকে। তবে দেবীর আর্বিভাব মাস উপলক্ষ্যে পৌষ মাসজুড়ে ব্যাপক ভিড় হয়ে থাকে। এবছরও পৌষের প্রথমদিনে তার ব্যতিক্রম হল না। এদিন প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। বুধবার সকাল থেকেই পুজো দেওয়ার লাইন পড়ে যায় মন্দিরের গেটে। স্থানীয় বাসিন্দারা ছাড়াও প্রতিবেশী বীরভূম ও পূর্ব বর্ধমান জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকেও ভক্তের দল পুজো দিতে এসেছিলেন। বীরভূমের বাসিন্দা পাপন দাস বলেন, বহু বছর ধরেই এই মাসের প্রথম মঙ্গলবার আমরা পুজো দিতে আসি। এবারও পরিজনদের নিয়ে মন্দিরে এসেছি। দেবী মনোস্কামনা পূরণ করেছেন। মন্দিরের পুরোহিত শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, সারা বছর মন্দিরে ভক্তরা এলেও পৌষমাসে ভিড় উপচে পড়ে। যার ব্যতিক্রম হল না এবছরও। পৌষের প্রথম দিনেই হাজারের বেশি ভক্তের সমাগম হয়েছে।
এদিন স্থানীয় দোহালিয়া গ্রামের অধিকাংশ বাসিন্দা মন্দিরে পুজো দিতে আসেন। তাঁদের হাতে ছিল মুলো ও সর্ষের গাছ। পুরনো প্রথা মেনে এই গ্রামের বাসিন্দারা শীতকালীন জমির ফসল প্রথমে গ্রাম্য দেবতা দক্ষিণাকালীকে উৎসর্গ করেন। তারপর ওই ফসল বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন। মন্দিরের আর এক পুরোহিত পলাশ মুখোপাধ্যায় জানান, হাজার বছরের প্রাচীন প্রথা এটি। শীতকালীন ফসল প্রথমে দেবতাকে উৎসর্গ করার পরে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এখন অনেকের জমি না থাকার কারণে প্রথার কিছুটা রদবদল হয়েছে। এখন বাজার থেকে মুলো ও সর্ষেগাছ কেনার পরে মন্দিরে নিয়ে আসেন অনেকে।
মন্দির চত্বরে সোমবার থেকেই শুরু হয়েছে পৌষমেলা। মেলায় বিভিন্ন স্টল বসতে শুরু করেছে। খেলনা থেকে রেস্তরাঁ, গৃহসামগ্রী থেকে শীতবস্ত্রের দোকান রয়েছে। এক মাস ধরে এই মেলা চলবে বলে মেলা কমিটি সূত্রে জানানো হয়েছে। তবে দর্শনার্থী ও ভক্তদের নিরাপত্তার বিষয়ে এবার জোর দিয়েছে কমিটি। মন্দির কমিটির সম্পাদক গৌরব চট্টোপাধ্যায় বলেন, সকলের নিরাপত্তার জন্য গ্রামের শতাধিক পুরুষ ও মহিলাকে নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরি করেছি। পুলিস ক্যাম্পও থাকছে। বেশকিছু সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। মন্দিরের সামনে একাধিক অ্যাম্বুলেন্স থাকছে।
অন্যদিকে নবগ্রামের শতাব্দী প্রাচীন কিরীটেশ্বরী পৌষমেলামঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে । এদিন মেলার প্রথম দিনে দর্শনার্থীদের পাশাপাশি মায়ের পুজো দিতে প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। স্থানীয়দের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত কয়েকশো পুরুষ-মহিলা মায়ের উদ্দেশ্যে পুজো ও অঞ্জলি নিবেদন করেন। সকাল, দুপুর এবং রাত তিনবেলা মায়ের উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হয়। পুজো দেওয়ার পাশাপাশি দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামতেই মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। প্রথমদিন থেকেই মেলায় প্রচুর মানুষের সমাগম হওয়ায় হাসি ফুটেছে ব্যবসায়ীদের মুখে।
৫১ পীঠের অন্যতম সতীপীঠ মুর্শিদাবাদের নবগ্রাম থানার কিরীটেশ্বরী। সতীর কিরীট বা মাথার মুকুট পড়েছিল বলে এই স্থানের নাম হয় কিরীটকণা। পরে এই জায়গার নাম হয় কিরীটেশ্বরী। কয়েকশো বছরের প্রাচীন এই পৌষমেলা বলে দাবি স্থানীয়দের। পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার মায়ের উদ্দেশ্যে পুজো দিতে ভক্তদের ঢল নামে। মায়ের পুজো উপলক্ষ্যে হাজার হাজার ভক্ত সমাগমের ফলে মন্দিরের সামনের মাঠে একমাস ব্যাপী মেলা বসে। এক মাস ব্যাপী এই মেলা কিরীটেশ্বরী পৌষমেলা নামে পরিচিত। দিন দিন এই কিরীটেশ্বরী মেলার শ্রীবৃদ্ধি ঘটছে বলে গ্রামবাসীদের দাবি। কিরীটেশ্বরী মেলার মিষ্টি ও বিন্নি ধানের খই বিখ্যাত। খাবার, বাচ্চাদের খেলনা ও সাংসারিক জিনিসের স্টল বসেছে। ছোটদের বিনোদনের নাগরদোলা, ড্রাগন ট্রেন, মিকি মাউস, চরকি সহ একাধিক উপকরণ এসেছে। মন্দির কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, সারা বছর ধরেই অল্পবিস্তর দর্শনার্থী ও ভক্ত সমাগম হয় এখানে। কিন্তু পৌষমেলা উপলক্ষ্যে জেলা, রাজ্য ও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মায়ের উদেশ্যে পুজো দিতে এবং মায়ের রাজ রাজেশ্বরী রূপ দর্শন করতে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হয়। মঙ্গলবার সপ্তাহের একটা দিন মাকে রাজ রাজেশ্বরী বেশে সাজিয়ে পুজো করা হয়। তাই শনিবারের তুলনায় মঙ্গলবারে ভক্ত সমাগম বেশি হয়। নদীয়ার ঘূর্ণি থেকে পরিবার নিয়ে পুজো দিতে এসেছিলেন বিপ্লব রায়। তিনি বলেন, মাসের প্রথম দিন মঙ্গলবার পড়েছে। এদিকে তৃতীয় সপ্তাহ থেকে খুব ভিড় হয়। তাই কালবিলম্ব না করেই চলে এলাম। পুজো নেওয়ার পাশাপাশি মায়ের রাজরাজেশ্বরী রূপ দর্শন করলাম। মন্দির কমিটির সম্পাদক সৌমিত্র দাস বলেন, কিরীটেশ্বরী তথা নবগ্রামের মানুষ বছরভর এই মেলার দিকে তাকিয়ে থাকেন। এই সময়ে জেলা এবং জেলার বাইরে থেকেও প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। ফলে স্থানীয়দেরও আয়ের সুযোগ থাকে। মন্দিরের সেবাইত দিলীপ ভট্টাচার্য বলেন, প্রথম দিন ভালোই ভক্ত সমাগম হয়েছে। আশা করছি, মেলার বাকি দিনগুলিতেও ভক্তের ঢল নামবে।আবার পৌষ মাসের শুরু থেকেই বহরমপুরের ঐতিহ্যবাহী বিষ্ণুপুর কালীমন্দিরে মানুষের ভিড়। মঙ্গলবার ভোর থেকেই মানুষ লাইন দিয়ে পুজো দিতে থাকেন। পৌষ মাসে এই মন্দিরে ঘটা করে মা কালীর পুজো হয়। প্রায় ৩০০ বছর ধরে এই পুজো হচ্ছে। পুজো উপলক্ষ্যে যে মেলা বসে, তাও অত্যন্ত প্রাচীন। প্রতিবছর পৌষ মাসের শুরু থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে এই মেলা চলে। আগে শুধু শনি ও মঙ্গলবারে মেলা হতো। এক সময়ে এই মন্দিরের পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব ছিল। সেই আতঙ্কে দূর থেকে আগত পুণ্যার্থী সন্ধের আগেই মন্দির প্রাঙ্গণ ছাড়তেন। আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে সেই সময়ের কথা।
বিষ্ণুপুর কালী মন্দিরের সেবাইত বীতশোক পান্ডে বলেন, পয়লা পৌষ থেকে মেলা শুরু হল। জেলা ও জেলার বাইরে থেকে মায়ের কাছে আসেন মানুষ। এদিন ভোর পাঁচটা থেকে মায়ের পুজো শুরু হয়েছে। পৌষ মাস মায়ের আবির্ভাব মাস। সেই উপলক্ষ্যে প্রতিবছর পুজোর আয়োজন করা হয়। সেই উপলক্ষ্যেই দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন বলে এখানে মেলাও বসে। এবার একশোর বেশি স্টল হয়েছে এই মেলায়।তিনি আরও বলেন, বরাবরই প্রথম দিন বেশি ভিড় হয়। এদিন ভোর থেকে প্রধানত শহরের মানুষ পুজো দেওয়ার জন্য বেশি ভিড় জমিয়েছিলেন। মা অত্যন্ত জাগ্রত বলেই এখানে মানুষ ভিড় করেন। সকলের মনস্কামনা পূরণ করেন মা। পাশাপশি সুষ্ঠুভাবে পুজো দিতে পারেন সকলে। মায়ের আশীর্বাদ সকলের উপর যাতে থাকে সেই কামনায় এদিন প্রথম পুজো হল। এদিনই প্রায় ৮ হাজার মানুষ এখানে পুজো দিয়েছেন। এক সময় বাঘের উপদ্রবে মানুষ বিকেলের পর এলাকা ছেড়ে চলে যেতেন। এখন অনেক রাত পর্যন্ত জাঁকজমক সহকারে মেলা চলে। স্থানীয় বাসিন্দা অরূপচন্দ্র বিশ্বাস বলেন, আজ থেকে দশ বছর আগে যে ভিড় হতো, তার তুলনায় এখন অনেক বেশি ভিড় হয়। স্থানীয় দোকানে ভালো ব্যবসা হয়। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এই মেলায় স্টল দেন। তাঁদের ভালো বিক্রি হয়। মেলায় স্টল দেওয়া ভবতোষ মল্লিক বলেন, গত তিন বছর ধরে এই মেলায় পসরা সাজিয়ে বসছি। প্রতিবারই ভালো বিক্রি হয়। জেলায় অনেকগুলো মেলা হয়। কিন্তু আমরা এই কালীবাড়ির মেলাতেই আসি।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )