
‘কোনও ভোট কাটাকাটি বরদাস্ত নয়’, মুর্শিদাবাদের নির্বাচনী সভা থেকে কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপিকে নিশানা মমতার
রাজেন্দ্র নাথ দত্ত:মুর্শিদাবাদ:- বাংলাতে বিজেপির দুটি চোখ, একটা কংগ্রেস একটা সিপিএম। তারা বিজেপির হয়ে তৃণমূলের ভোট কাটার চেষ্টা করছে। সোমবার মুর্শিদাবাদের খড়গ্রামে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী খলিলুর রহমানের সমর্থনে ভোট প্রচার করতে এসে এই ভাবেই বাম-কংগ্রেস জোটকে আক্রমণ করলেন তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা ব্যানার্জি। মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের বাম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমের নাম না করে তিনি বলেন, “উড়ে এসে একজন “বাজপাখি” মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে দাঁড়িয়েছেন। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে কংগ্রেস সেলিমকে লড়তে পাঠিয়েছে। উত্তর দিনাজপুরে ফরওয়ার্ড ব্লকের রমজানকে লড়তে পাঠিয়েছে। মালদাতেও একজনকে পাঠিয়েছে। অর্থাৎ যেগুলো তৃণমূলের পাক্কা সিট তাতে জল ঢেলে দিয়ে, ঘোল ঘেঁটে দিয়ে যাতে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট কেটে বিজেপিকে জেতানো যায় তার চেষ্টা করছে।” আজকের জনসভা থেকে ফের একবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ১০০ দিনের কাজের হিসাব নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার চ্যালেঞ্জ ছোড়েন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তিনি বলেন,” ১০০ দিনের কাজের টাকা তৃণমূল কংগ্রেস চুরি করেছে? একটা প্রমান দেখাক। আমি তো চ্যালেঞ্জ করছি একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করে বলুন বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাটে কি অবস্থা। তিন বছর ধরে তারা বাংলার শ্রমিকদের মজুরি আটকে রেখেছে। অন্যদিকে বাংলাতে ৩৫০ টা কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়েও কিছু খুঁজে পায়নি।” তৃণমূল সুপ্রিমো ফের একবার রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে নাম না করে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। মমতা ব্যানার্জি বলেন ,”একটা নেতা না ন্যাতা , লিডার না ল্যাডার কী আছে ভগবান জানে। বোমা ফাটাবো বলছে। লজ্জা করে না তোর। ২৩ হাজার ছেলে মেয়ের চাকরি খেয়ে উল্লাস করছে।” বাড়ির ভাই বোনের চাকরি গেলে কী করতেন সেই প্রশ্নও করেছেন। নিজেকে বাঁচাতে বিজেপির মেশিনে ঢুকেছেন বলেও উল্লেখ করেন। মমতা বলেন, “সিস্টেম অনুযায়ী সকলে পরীক্ষা দিয়েছে। দু-একটা যদি ভুল ত্রুটি হয়ে থাকে আমরা শুধরে নিতাম।” অন্যদিকে মধ্যপ্রদেশে শিক্ষা দুর্নীতি “ব্যাপম” তদন্তের কী হল সেই নিয়েও আজ প্রশ্ন তোলেন মমতা ব্যানার্জি।
তৃণমূল সুপ্রিমো বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুধু মিথ্যা কথা বলেন। আগামী দিন বিজেপি ক্ষমতায় এলে কারও স্বাধীনতা থাকবে না। এনআরসি করে সবাইকে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবে। সিএএ করে সবাইকে তাড়িয়ে দেবে। আপনারা কি চান দেশ বিক্রি হয়ে যাক, দেশের সংবিধান ভেঙে যাক, লক্ষ্মীর ভান্ডার বন্ধ হয়ে যাক, সংখ্যালঘু -তপশিলি-দলিতদের অস্তিত্ব কেড়ে নেওয়া হোক?” মমতা ব্যানার্জি ফের একবার জানিয়ে দেন, “বাংলাতে এনআরসি, সিএএ বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড কিছুই করতে দেওয়া হবে না। হিন্দু -মুসলিম আমরা এখানে একসঙ্গেই থাকবো, পাশে দাঁড়াবো। এটা আমাদের নীতি পদ্ধতি।লোকসভা নির্বাচনে কেন্দ্র থেকে বিজেপিকে সরাতে বিরোধীরা মিলে তৈরি করেছিল ইন্ডিয়া জোট। নাম দিয়েছিলেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে সেই জোট বিশেষ পাকাপোক্ত হয়নি। তাই মমতার ফর্মুলা মেনে যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক দল শক্তিশালী, সে সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়নি। বাংলায় তো গোড়া থেকেই এই আসন সমঝোতা হয়নি। তৃণমূল নেত্রী ঘোষণা করে দিয়েছিলেন, বাংলার ৪২ আসনেই প্রার্থী দেওয়া হবে। সেইমতোই কাজ করেছে শাসকদল।আর তার পর থেকেই নির্বাচনী প্রচারে লাগাতার সিপিএম-কংগ্রেসকে আক্রমণ শানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় । ভোট কাটাকাটি করতে বিজেপির পরিকল্পনা অনুযায়ী বাম-কংগ্রেস বিভিন্ন আসনে সমঝোতা করে প্রার্থী দিয়েছে, এমনই অভিযোগ তাঁর। সোমবার মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় নির্বাচনী সভা থেকে তিনি কটাক্ষ করেই বললেন, ”ওদের তো একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি। সিপিএম কিনলে কংগ্রেস ফ্রি, কংগ্রেস কিনলে সিপিএম ফ্রি।” পাশাপাশি মুর্শিদাবাদের সিপিএম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে ‘বাজপাখি’ বলেও কটাক্ষ করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো।আগামী ৭ মে, লোকসভা ভোটের তৃতীয় দফা ভোটে শামিল হবেন মুর্শিদাবাদের ভোটাররা। ওইদিনই আবার ভগবানগোলা বিধানসভা উপনির্বাচনেও ভোট দেবেন তাঁরা। ফলে দুই নির্বাচনের প্রচারেই সোমবার জনসভা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান থেকেই সিপিএম-কংগ্রেসের ‘ভোট কাটাকাটির পরিকল্পনা’ নিয়ে তীব্র কটাক্ষ করলেন। তাঁর কথায়, ”কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, বাজপাখি সেলিম। উনি জিততে পারবেন না। বিজেপির পরিকল্পনায় এরা কোথাও সিপিএম, কোথাও কংগ্রেস প্রার্থী দিয়েছে। বিজেপিকে হারাতে নয়, তৃণমূলের পাকা আসনে প্রার্থীদের হারাতে এই প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। বিজেপি দেখবেন এদের টাচ করে না। অথচ তৃণমূলের সব নেতানেত্রীকে কীভাবে হেনস্তা করা হয়।” এর পর নেত্রীর আরও সংযোজন, ”একটায় দুটো ফ্রি। সিপিএম কিনলে কংগ্রেস আর কংগ্রেস কিনলে সিপিএম ফ্রি।”
এদিনের সভা থেকে ইন্ডিয়া জোটের কথা উল্লেখ করে কংগ্রেসের ভূমিকার সমালোচনা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ”ইন্ডিয়া জোটে আমি আছি, ওই নাম আমিই দিয়েছিলাম। কিন্তু সিপিএম-কংগ্রেসের বন্ধ জোটে নেই। কংগ্রেসকে বলেছিলাম, এখানে তোমাদের দুটো আসন দিচ্ছি। একার ক্ষমতায় লড়ো। কিন্তু শুনল না। মুর্শিদাবাদ, রায়গঞ্জ, মালদহে তৃণমূলের ভোটবাক্সে থাবা বসানোর লক্ষ্যে ওখানে প্রার্থীদের দাঁড় করিয়েছে। লাভ নেই। মনে রাখবেন, তৃণমূল প্রার্থীরা জিতলে আপনাদের জন্য কাজ করবে। ভোট কাটাকাটিতে যাবেন না।’খাওয়াবেন তো? সভায় জনগণের উদ্দেশে আবদার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – এর। হঠাৎ সভা থেকে কেন এমন আবদার করলেন তিনি? কীসের জন্য তিনি জনসাধারণের উদ্দেশে খাওয়ানোর আবদার করেন? জঙ্গিপুরের সভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই আবদারের কারণ, তাঁর কিছু কথা যদি সত্যি হয়।চাঁদিফাটা গরমে জঙ্গিপুরের সভায় বক্তৃতা রাখছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সময়ই লোকসভা নির্বাচনে কী ফলাফল হবে, সেই নিয়ে কিছু মতামত প্রকাশ করছিলেন তিনি। এরপরেই তিনি জনগণের উদ্দেশে খাওয়ানোর আবদার করেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে জনগণের থেকে কোনও কিছু উপহার নেন না মুখ্যমন্ত্রী। উপহার কেউ দিতে এলেও সেটা তাঁকে ফিরিয়ে দেন তিনি। টানা একমাস টানা প্রচারের মাঝেই এদিন আবদার শোনা গেল তাঁর গলায়।মমতা এদিন বলেন, ‘যে দুটো দফায় ভোট হয়ে গিয়েছে, সেখানে বিজেপি এপাস, ওপাস, ধপাস হয়ে গিয়েছে। বাদ বাকি যে পাঁচটা দফায় নির্বাচন হবে, তার জন্য বুক দুরুদুরু করছে। এবারের লড়াইটা মনে রেখো – দুর্গম গিরি কান্তার মরু, দুস্তর পারাবার, লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার’, এই লড়াইটা আমাদের জিতবে হবে।’এরপরেই ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা মনে করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেইবার বিজেপির ভালো ফল করে সরকার গড়ার আশা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকারে আসতে পারেনি বিজেপি। মমতা বলেন, ‘অটলজী ভালো মানুষ ছিলেন, আমরা তাঁরা বিরুদ্ধে একটা কথাও বলিনি। অটলজীর আমলে বিজেপির স্লোগান ছিল ইন্ডিয়া সাইনিং। মানুষ কিন্তু উল্টো করে দিয়েছিল। ভোট দেয়নি।’
এবারের লোকসভা নির্বাচনেও অনেকটা সেরকম ফল হবে বলে আশাপ্রকাশ করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিজেপিকে কটাক্ষ করে তিনি বলেন, ‘প্রচারবাবু বলেছেন, ইস বার ৪০০ পার, আমি বলি ইস বার পগারপাড়, যদি এই কথাগুলো সত্যি হয়, খাওয়াবেন তো? কি মুর্শিদাবাদের মানুষ খাওয়াবেন তো? কি মালদার মানুষ খাওয়াবেন তো?’ বিজেপির সরকারের পতনের কথা বলেই তিনি খাওয়ানোর আবদার রাখেন মানুষের কাছে।
স্বভাবসিদ্ধ ভাবে এদিনের সভা থেকেও বিজেপিকে তুলোধনা করেন বিজেপিকে। পাশাপাশি, সিপিএম- কংগ্রেসকেও একযোগে আক্রমণ করেন তিনি।মমতা আরও বলেন, ‘আমি জাকিরকে বলে গেলাম, খলিলুরকেও বলে যাচ্ছি, সবাইকে বলে যাচ্ছি, নজর দিতে হবে, এরা সকাল সন্ধ্যা গালাগালি দেবে, আর ভোট কেটে, সংখ্যালঘুদের ভোট ভাগ করে বিজেপিকে জেতাবে, এই ভুলটা আমরা যেন না করি, আমি আমার কথা আপনাদের কাছে বললাম, আবেদন করলাম।’