কৃষ্ণজায়া
নীহার চক্রবর্তী (বেথুয়াডহরি, নদীয়া)

অসীম বেশ কয়েকদিন দেখেছিলো ওর বাবাকে স্টেশনে এক অচেনা মহিলার সঙ্গে কথা বলতে। দেখে ও লুকিয়ে পড়ে।
পরে মনে হয় ওর, মাকে বলে দিলে কেমন হয়?
কিন্তু ওই পর্যন্তই।
মাকে বলার আর প্রয়োজনবোধ করেনি ও।
পরে মনে-মনে বলে,আমি কতটুকুই বা চিনি ওই মহিলাকে। বাবার তো চেনা হতে পারে।
তবে মহিলাটির কথা বলার ভঙ্গী আর হাসি ওর খুব ভালো লাগে। ছিপছিপে চেহারার মধ্যে দেখতে বেশ। বুকটাও বেশ উছাল।
অসীম ওই মহিলাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
ওর মন বলে, একদিন সামনাসামনি হওয়া যাবে । তখন আমিই না হয় কথা বলবো।
কিন্তু কিছুদিন যেতেই অসীমের মাথায় যেন বাজ পড়ে গেলো। একদিন ও মাকে ঘরের এককোণে বসে অঝোরে কাঁদতে দেখল।
মার কাছে কান্নার কারণ জানতে চাইলো তখন।
মা চোখের জল ফেলতে-ফেলতে বলল, ‘এখন আর বলে কি হবে। আমরা শেষ। তোর বাবা আজ স্বীকার করেছে কিছু টাকা দিতে হয় ওর বন্ধুর এক বিধবা দিদিকে। তার নাকি কেউ নেই ইহজগতে।’
অসীম তখন ব্যাপারটা বুঝে যায় ব্যাপারটা । শুনে খুব রাগ হয় ওর।
বিড়বিড় করতে থাকে, আমাকে বললে আমি কি দিতে পারতাম না? দেখাও তো হল সেদিন। তখন কত হাসি মুখে তার।
মাকে বলল,’অপেক্ষা কর। আমি দেখছি।’
কিন্তু দেখার কাজ শেষ।
দুদিন পর মার মুখে অসীম শুনল, ‘ওই মহিলাকে মন্দিরে গোপনে সিঁদুর পরিয়েছে তোর বাবা। কে এক দেখে বলেছে অতুলের বাবাকে।’
আবার রাগ হল খুব অসীমের।
জ্বলে উঠে মনে-মনে বলল, আমি কি সিঁদুর পরাতে পারতাম না? বাবা কতদূর কি পারে আমিও দেখছি । আমি পিছনে আছি।
এক সপ্তাহ পরেই অসীম একদিন বাইরে বাড়ি ফিরে এসে মার মুখে শুনল, ‘তোর হারামি বাবা পালিয়েছে ওই মহিলার সাথে। কে এক দেখে বলেছে শ্যামলের মাকে।’
মা খুব জোরে-জোরে কাঁদতে শুরু করলো।
অসীম সব শুনে অনেকক্ষণ চুপ থামার পর হেসে উঠে বলল, ‘আমি দেখছি। বাবা যে কি করবে আমার জানা আছে। কদিন না হয় আমিই চালিয়ে দিচ্ছি।’
অসীম মনে মনে খুঁজতে শুরু করলো ওর বাবাকে। পরিবার চালানোর ইচ্ছাটাও ওর দমে গেলো অনেক।
তবে মাকে না জানানোর অপরাধ ওকে খুব পেয়ে বসলো।
সেই লজ্জায় মনের সুপ্ত ইচ্ছা আরও সুপ্ত রেখে বাবার ফেলে যাওয়া মুদির দোকানে গিয়ে বসলো ও ।
তবে তার পনেরো দিন পরেই ফিরে এলো অসীমের বাবা। অসীম তাকে দেখে বেশ অবাক। নাকে তার রসকলির চিহ্ন। পরনে বৈষ্ণবের পোশাক।
ওর মাকে অমায়িক-হেসে সে বলল, ‘তুমার মাতা খারাপ হইছে নাহি? আমি করুম পেরেম? নাহ। আমরা কজন গিয়েছিলাম বৃন্দাবনে। আমার বন্ধুর বোনও ছিল আমার লগে। সে এখন পুরা বৈষ্ণবী। কি আর করন আছে তার। মঠে চইলা গেলো আইসাই। এবার আমি কৃষ্ণভজে সংসার-ধরম পালন করুম।’
তার কথা শুনে অসীমের মা চোখের জল ফেলতে ফেলতে হেসে ফেললো একমুখ।
অভিমানের গলায় বলল, ’তাই বল। আমি এখানে ভেবে মরি। অত অভিনয় কর কেন?’
অসীম সব শুনে,সব বুঝে লজ্জায় মরে।
মনে-মনে বলে, আমি কার জন্য ভাবছিলাম? এ তো দেখি বুড়ী-মনের মহিলা। এ আমার জন্য নয়। বাবার জন্যও নয়। কৃষ্ণ-সাধিকা।
তারপরেই অসীম সসম্মানে ওর বাবাকে দোকান ছেড়ে দিয়ে সারা মুখে হাসি নিয়ে বলল, ‘ আমি তবে আজ থেকে কলেজে চললাম।’
বাবা ওর এককথায় রাজী । খুব খুশি ওর মা।
মজার সুরে অসীম বাবাকে শুধু বলল, বৈরাগ্য-সাধনের মুক্তি তোমার জন্য নয় গো। ভুলছিল আমার ভাবনায়।’
ওর বাবা শুনে চমকে উঠলো। মা শুনে হেসে ফেললো। মঠ থেকে শোনা গেলো তখন এক নারী-কণ্ঠে কান্না-ভেজা কৃষ্ণনাম।