ভালবাসা
রুদ্র সেনগুপ্ত (কলকাতা)

বসন্ত নয় আমার দরজায় প্রথম কড়া নেড়েছিল অবহেলা।
ভেবেছিলাম অনেকগুলো বর্ষা শেষে শরতের উষ্ণতা মিশিয়ে এলো বুঝি বসন্ত!
দরজা খুলে দেখি আমাকে ভালোবেসে এসেছে অবহেলা।
মধ্য দুপুরে তীর্যক রোদের মত অনেকটা নির্লজ্জের মতো আমাকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল অনাকাঙ্ক্ষিত অবহেলা।
আমি চারপাশে তাকিয়ে দেখেছিলাম আমার দীন দশায় কারো করুণা বা আর্তির পেখম ছড়িয়ে আছে কী না!
ছিল না।
বৃষ্টিহীন জনপদে খড়খড়ে রোদ যেমন দস্যুর মত অদমনীয়
তেমনি অবহেলাও আমাকে আগলে রেখেছিল নির্মোহ নিঃসঙ্কোচিত।
আমি অবহেলাকে পিছনে ফেলে একবার ভোঁ-দৌড় দিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম।
তখন দেখি আমার সামনে কলহাস্যে দাঁড়িয়েছে উপেক্ষা।
উপেক্ষার সঙ্গেও একবার কানামাছি খেলে এগিয়ে গিয়েছিলাম তোমাদের কোলাহল মুখর আনন্দ সভায়।
কী মিলেছিল?
ঠোঁট উলটানো ভৎসনা আর অভিশপ্ত অনূঢ়ার মতো একতাল অবজ্ঞা।
তাও সয়ে গিয়েছিলাম একটা সময়।
ধরেই নিয়েছিলাম আমার কোনো কালেই হবে না রাবেন্দ্রিক প্রেম
তোমাদের জয়গানে করতালিতে নতজানু থেকেছিলো আমার চাপা আক্ষেপ লজ্জা
বুঝে গিয়েছিলাম জীবনানন্দময় স্বপ্ন আমাকে ছোঁবে না
জয়নুলের রঙ নিয়ে কল্পনার বেসাতি
হারানো দিনের গানের ঐন্দ্রালিক তন্ময়তা
বা ফুল, পাখি, নদীর কাব্যালাপে কারা মশগুল হলো, এ নিয়ে কৌতূহল দেখাবার দুঃসাহস আমি দেখাইনি কখনো
এত কিছু নেই জেনেও নজরুলের মতো বিদ্রোহী হবো, সেই অমিত শক্তিও আমার ছিল না
মেনে নেয়ার বিনয়টুকু ছাড়া আসলে আমার কিছুই ছিল না
শুধু ছিল অবহেলা, উপেক্ষা আর অবজ্ঞা।
হ্যাঁ, একবার তুমি বা তোমরা যেনো দয়া করে বাঁকা চোখে তাকিয়েছিলে আমার দিকে।
তাচ্ছিল্য নয় একটু মায়াই যেনো ছিল,
হতে পারে কাঁপা আবেগ ও মিশ্রিত ছিল তোমার দৃষ্টিতে।
ওইটুকুই আমার যা পাওয়া।
আমি ঝরে যাওয়া পাতা,
তুমি ছিলে আকষ্মিক দমকা হাওয়া।
তারপরও অবহেলার চাদর ছাড়িয়ে উপেক্ষার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে ও অবহেলার লাল দাগ মুছে জীবনের কোনো সীমারেখা ভাঙ্গতে পারিনি আমি।
একথা জানে শুধু অন্তর্যামী।
অনেক স্বপ্নপ্রবণ হয়ে একবার ভেবেছিলাম
এই অবহেলা তুষারপাতের মুখচ্ছবি,
উপেক্ষা কাচের দেওয়াল,
অবজ্ঞা কুচকুচে অন্ধকার
এর কিছুই থাকবে না একটি বসন্তের ফুঁৎকারে।
একটি ঝলমলে পোশাক গায়ে চড়িয়ে হাতের মুঠোয় বসন্ত নিয়ে অন্তত একটি সন্ধ্যাকে উজ্জ্বল করে নেবো।
এমন ভাবাবেগও ছিল আকাশের কার্নিশে লেপ্টে থাকা পেঁজা মেঘের মতো
ঐ মেঘ কখনো বৃষ্টি হয়ে নামেনি।
তোমার বা তোমাদের নাগরিক কোলাহল কখনো থামেনি
অর্ধেক জীবন ফেলে এসে দেখি
অনেক কিছু বদলে গেছে।
সেকি!
কোথায় হারালো কৈশোরের দিনলিপি বিপন্ন করা অবহেলা
স্বপ্নকে অবদমনের স্বরলিপিতে আঁটকে
ফেলা উপেক্ষা
আর তারুণ্যকে ম্রিয়মাণ করে রাখার অবজ্ঞা!
ওরা আমাকে চোখ রাঙাতে পারে না ঠিক, তবে এখনো পোড় খাওয়া দিন বড্ড রঙিন
আমি আজ সমুদ্র জলে হাত রেখে বলে দিতে পারি
কোন ঢেউয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তোমাদের গোপন অশ্রুকণা
আকাশ পানে তাকিয়ে বুঝতে পারি কার দীর্ঘশ্বাসে ঝড়ে পড়ছে নক্ষত্র
এমনকি তুমি যে সম্রাজ্ঞীর বেশের আড়ালের মিহিন কষ্ট চেপে হয়েছ লাবণ্যময় পাষাণ, পাথর
এটাও দেখতে পাই অন্তরদৃষ্টি দিয়ে
আমি জানি, দীর্ঘশ্বাসে ভরা এ আখ্যান যদি পেতো কবিতার রূপ
সেই অবহেলা হতো বসন্ত স্বরুপ।
দর্পন কবীর।