চিত্তরঞ্জনে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের অপরাধে আতঙ্কিত শহর

চিত্তরঞ্জনে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের অপরাধে আতঙ্কিত শহর

কৌশিক মুখার্জী: চিত্তরঞ্জন:-

চিত্তরঞ্জন,প্রকৃতির কোলে লালিত এক শান্তির স্বর্গরাজ্য,যেখানে সরল জীবনধারা ও মানবিকতার সুবাসে মুখরিত ছিল প্রতিটি পথঘাট। কিন্তু এই নির্মল শান্তির আড়ালে সম্প্রতি এক অন্ধকার ছায়া নেমে এসেছে, যা শহরের নিরাপত্তার ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছে। কর্নেল সিং পার্কের কাছে ঘটে যাওয়া এক চাঞ্চল্যকর ছিনতাইয়ের ঘটনা শুধু অপরাধের একটি কাহিনি নয়, বরং চিত্তরঞ্জন কেজি হাসপাতালের নিরাপত্তারক্ষী বিমল মণ্ডল ও বান্টি মণ্ডল, সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা জীবন মণ্ডল ও রাহুল মণ্ডলএর অপরাধে জড়িত থাকার মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীর সংকট উন্মোচন করেছে। আরও উদ্বেগজনক, এই অভিযুক্তরা সকলেই রূপনারায়ণপুরের ডাবর মোর নিবাসী সনৎ মণ্ডলএর আত্মীয় বা পূর্বপরিচিত। এই ঘটনা জনমনে গভীর আতঙ্ক ও ক্ষোভ জাগিয়েছে, যারা নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তারাই যখন অপরাধের পথে, তখন শান্তির এই শহর কার ভরসায় টিকে থাকবে?গত শনিবার সন্ধ্যায় জোর বাড়ি থেকে ফতেপুরের পথে যাওয়া এক যুবক ও যুবতীর জীবনে নেমে আসে অকল্পনীয় আতঙ্ক। অভিযুক্তরা, সিপিভিএফ-এর ইউনিফর্মের আদলে তৈরি পোশাক পরে, নিজেদের পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে তাদের পথ আটকায়। ভয় দেখিয়ে তাদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না দিলে মোবাইল ফেরত না দেওয়া এবং মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেয় তারা। ভীত-সন্ত্রস্ত যুবক-যুবতী ফতেপুর থানায় অভিযোগ জানালে পুলিশের তৎপর তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিমল মণ্ডল, মোহনপুরের বাসিন্দা এবং বান্টি মণ্ডল, সনৎ মণ্ডলএর ছেলে, দুজনেই চিত্তরঞ্জন কেজি হাসপাতালে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে কর্মরত। অন্য দুজন, জীবন মণ্ডল, ঝাড়খণ্ডের বাসিন্দা এবং রাহুল মণ্ডল, ঝাড়খণ্ডের রাঙাশোলার বাসিন্দা, সনৎ মণ্ডলএর পরিচিত।এই সম্পর্ক অপরাধের পিছনে এক গভীর নেটওয়ার্কের আভাস দেয়।চিত্তরঞ্জন কেজি হাসপাতাল, যেখানে প্রতিদিন শত শত রোগী, তাদের পরিবার ও শিশুরা চিকিৎসার আশায় ভিড় করেন, সেখানে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিমল মণ্ডল ও বান্টি মণ্ডলএর অপরাধে জড়ানো শহরবাসীর মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। যারা অসুস্থ মানুষের নিরাপত্তার প্রহরী হওয়ার কথা, তারাই যখন অপরাধের হাতিয়ার হিসেবে নিজেদের ইউনিফর্ম ব্যবহার করে, তখন বিশ্বাসের ভিত্তি ভেঙে পড়ে। একজন স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভে ফেটে পড়ে বলেন, “হাসপাতালে আমরা নিরাপত্তার আশায় যাই, কিন্তু যখন জানি নিরাপত্তা রক্ষীরাই অপরাধী, তখন আমরা কোথায় ঠাঁই পাব?” এই ঘটনা শুধু একটি ছিনতাই নয়, বরং নিরাপত্তা ব্যবস্থার গভীর ত্রুটি এবং প্রশাসনের অবহেলার এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি।শহরবাসীর অভিযোগ, চিত্তরঞ্জন ও রূপনারায়ণপুরে যোগ্য বেকার যুবকদের অঢেল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ঝাড়খণ্ড থেকে আগত ব্যক্তিদের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এর পিছনে রাজনৈতিক নেতা ও ঠিকাদারদের অদৃশ্য হাত রয়েছে বলে সন্দেহ। একজন বাসিন্দা বলেন, “আমাদের ছেলেরা চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে,আর বাইরের লোকজন চাকরি পেয়ে অপরাধ করে পালিয়ে যাচ্ছে। এর মূলে কারা, তা তদন্তের আলোকে বেরিয়ে আসুক।” সনৎ মণ্ডলএর সঙ্গে অভিযুক্তদের সম্পর্ক এই অভিযোগকে আরও তীব্র করে।বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়াও প্রশ্নের মুখে। বিমল মণ্ডল ও বান্টি মণ্ডলএর মতো ব্যক্তিরা কীভাবে এমন স্পর্শকাতর পদে ঠাঁই পেলেন? তাদের পটভূমি যাচাই বা প্রশিক্ষণের কোনো প্রক্রিয়া কি সত্যিই মানা হয়েছে, নাকি সংখ্যা পূরণের নামে যোগ্যতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে?সনৎ মণ্ডল এর নাম এই ঘটনায় বারবার উঠে আসছে, যিনি অভিযুক্তদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। এটি রাজনৈতিক ও ঠিকাদারি নেটওয়ার্কের গভীর প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়, যা অপরাধের পথকে প্রশস্ত করছে। অতীতে এ ধরনের ঘটনা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ফাইলবন্দি হয়ে গেছে, যা জনগণের আস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একজন সমাজকর্মী বলেন, “এই অপরাধ শুধু বিশ্বাসের প্রতি আঘাত নয়, প্রশাসনের অক্ষমতার প্রমাণ। যদি এবারও কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এমন ঘটনা শহরের শান্তিকে গ্রাস করবে।পুলিশ অভিযুক্তদের আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। কিন্তু শুধু শাস্তি দেওয়া এই সংকটের সমাধান নয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আনতে হবে, স্থানীয় যুবকদের যোগ্যতার ভিত্তিতে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোর পটভূমি যাচাইয়ের প্রক্রিয়া কঠোর করতে হবে। চিত্তরঞ্জন কেজি হাসপাতালে বিমল মণ্ডল ও বান্টি মণ্ডলএর মতো ব্যক্তিদের পরিবর্তে নৈতিক ও দায়িত্বশীল নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করা জরুরি, যাতে রোগী ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা অটুট থাকে।
কর্নেল সিং পার্কের এই ঘটনা চিত্তরঞ্জনের নিরাপত্তার গভীর সংকট, স্থানীয় বেকারত্বের জ্বলন্ত ক্ষোভ এবং সনৎ মণ্ডলএর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধের বিস্তারের এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। প্রশাসনের কাছে এখন একটিই প্রশ্ন—তারা কি এই ঘটনার গভীরে গিয়ে সনৎ মণ্ডলএর সঙ্গে জড়িত নেটওয়ার্কের তদন্ত করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে, নাকি এটিও অতীতের মতো ধুলোয় মিশে যাবে? চিত্তরঞ্জনের শান্তি ও নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ এখন প্রশাসনের স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও দৃঢ় সংকল্পের ওপর নির্ভর করছে।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )