দুর্গোৎসবে মেতে উঠতে চলেছে আপামর বাঙালি

দুর্গোৎসবে মেতে উঠতে চলেছে আপামর বাঙালি

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী:- 'দশভূজা মা দুর্গা কৈলাস থেকে এলো / কার্তিক, গণেশ সরস্বতী...', মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। তারপরই শুরু হতে চলেছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। শত পরিবর্তনও স্পর্শ করতে পারেনি শিরিষ রায় প্রবর্তিত মঙ্গলকোটের জয়পুরের 'রায়' বাড়ির দুর্গাপুজোকে। আজও এখানে সপরিবারে 'মা' আসেন একপাটায়। তবে 'মা' মৃন্ময়ী নন, পটের। আগে শিল্পী এসে রঙ, তুলি ব্যবহার করে মায়ের রূপ ফুটিয়ে তুলতেন। সবসময় শিল্পী পাওয়া যায়না বলে এখন কম্পিউটার প্রিণ্ট। পুজোর দু'চারদিন আগে থেকেই ফুল ও আলোর মালায় সেজে ওঠে মন্দির চত্বর। মাইকে বেজে ওঠে মিষ্টি সুরের পুরনো দিনের গান। এখানে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। অষ্টমীর দিন বলি হয় চাল কুমড়ো। দশমীর দিন ঘট বিসর্জনের আগে বিবাহিতা থেকে অবিবাহিতা প্রত্যেকেই মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। পুজোর চারদিন ধরেই চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শিল্পীরা সব পাড়ার ছেলেমেয়ে। ফলে প্রত্যেকের মধ্যে থাকে একটা আলাদা উৎসাহ। এভাবেই হাসি, ঠাট্টা, আনন্দের মধ্যে দিয়ে কেটে যায় পুজোর দিনগুলো। পটের ঠাকুর হলেও আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে ঠাকুর দ্যাখার আকর্ষণ একটুও কমেনি। তাদের বক্তব্য - মায়ের মৃন্ময়ী মূর্তি দেখা গেলেও পটের মূর্তি সহজে চোখে পড়েনা। তাই এর আকর্ষণ আলাদা।

পুজোর মধ্যে তথাকথিত আধুনিকতা না থাকলেও আছে আন্তরিকতা। এটাই সম্বল করে এগিয়ে চলেছে ‘রায়’ বাড়ি। এদিকে মঙ্গলকোটের সালন্দার 'রায়' বাড়ির মায়ের প্রকৃত রূপ হলো ‘মা’ কালী।জমিদার মোহন রায়ের সন্তানসম্ভবা 'মা' বসত ভিটে সিঙ্গট থেকে সালন্দায় চলে আসেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন কালী মায়ের ও পঞ্চমুণ্ডীর আসন। শুরু হয় কালী পুজো। পরে ঠাকুরের স্বপ্নাদেশ পেয়ে ‘মা’ কালী এখানে প্রায় গত দশ পুরুষ ধরে ‘মা’ দুর্গা রূপে পুজিতা হয়ে আসছেন। শুরু থেকেই 'মা' এখানে সপরিবারে এক পাটাতনেই আসেন। জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য মেনে ধুমধাম সহকারে পুজো শুরু হয়। সপ্তমীর দিন যখন ঘট আনতে যাওয়া হয় তখন গোটা গ্রামের প্রতিটি বাড়ির মেয়ে-বৌ সহ অন্যান্যরা সেই শোভাযাত্রায় পা মেলায়। আগে এখানে মোষ বলি হতো। এখন মোষ বলি নাহলেও মোষ বলির রক্ত যাবার ড্রেনের অস্তিত্ব দ্যাখা যায়। তবে অতীত ঐতিহ্য মেনে অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ছাগ বলি হয়। দশমীর দিন সন্ধ্যায় ঠাকুর বরণ করার সময় গ্রামের প্রত্যেকেই মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। পুজোর সময় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সবকিছুকেই অতিক্রম করে হিন্দু-মুসলিমের মিলনে এখানকার পুজো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন হয়ে ওঠে। নিত্যানন্দ মহাপ্রভুর ১৫ তম বংশধর মঙ্গলকোটের আওগ্রামের গোস্বামী পরিবারের সদস্য মুরারীমোহন গোস্বামী ছিলেন বর্ধমানের জনৈক ধনী প্রামাণিক বাড়ির কুলগুরু। প্রামাণিক বাড়ির সদস্যরা থাকতেন কলকাতায়। জাঁকজমক পূর্ণভাবে গ্রামের বাড়িতে দুর্গাপুজো হতো। শোনা যায়, দুর্গাপুজোর সময় একবার কলকাতা থেকে প্রামাণিক পরিবারের জনৈক সদস্য গ্রামের বাড়িতে আসেন। ফেরার পথে গাড়ির ইঞ্জিনে জল দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়লে চালক মণ্ডপের সামনে রাখা মঙ্গলঘটের জল গাড়ির ইঞ্জিনে ঢালে। ঘটে যায় চমকপ্রদ ঘটনা। মন্দিরে মায়ের সামনে রাখা ৪০ কেজি জল ধরা মঙ্গলঘটের জল শুকিয়ে যায়। একরাশ আতঙ্ক গ্রাস করে প্রামাণিক পরিবারকে। কুলুগুরুর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দীর্ঘদিনের পুজো বন্ধ করে দেয়। একইসময়ে রাতের বেলায় গোস্বামীদের চব্বিশ প্রহরের আটচালায় আশ্রয় নেয় জনৈক আগন্তুক। ক্লান্ত আগন্তুকের ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলেও লালপাড়ের শাড়ি পরিহিতা একটি মেয়ের নূপুরের রিনিঝিনি আওয়াজে সারারাত ঘুম হয়নি। পরের দিন সকালে মুরারীমোহন বাবুকে তিনি সমস্ত ঘটনা খুলে বলেন। ধর্মপ্রাণ মুরারীবাবু বর্ধমান ও এখানকার ঘটনার মধ্যে একটি মিল খুঁজে পান। তিনি অনুমান করেন বর্ধমান থেকে ‘মা’ নিজে এখানে এসেছেন পুজো নিতে। মুরারী বাবুর হাত ধরে পুনরায় শুরু হয় আওগ্রামের গোস্বামী বাড়ির দুর্গাপুজো। সন্তান সন্ততিদের সঙ্গে ‘মা’ এখানে আসেন এক পাটাতে। ডাকের সাজে সজ্জিতা হয়ে ওঠেন ‘মা’। মুহূর্তের মধ্যে মৃন্ময়ী 'মা' হয়ে ওঠেন চিন্ময়ী। পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন গোস্বামী পরিবারের কোনো সদস্য। প্রতিদিন ভোরবেলায় হয় সন্ধ্যা-আরতি। মায়ের চরণে জবা, ফুল, বেলপাতার অর্ঘ্যপাত্র দেওয়া হয় এবং অন্নপ্রসাদ নিবেদন করা হয়। এখানে সমস্ত রকম বলি নিষিদ্ধ। দশমীর দিন চিরাচরিত সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠে পাড়ার মহিলারা। প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয় দ্বাদশীর দিন। গোস্বামী বাড়ির পারিবারিক পুজো হলেও সমস্ত গ্রামবাসী এই পুজোয় অংশগ্রহণ করে। গোস্বামীরা মনে করেন ‘মা’ শুধু তাদের নয়, সবার। সবার মিলনে পুজো হয়ে ওঠে সত্যিকারের মিলনমেলা।। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার ঘোরোয়ার প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন প্রেস্টিজিয়াস প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও দুর্গাপুজোর আকর্ষণ ওরা ভুলতে পারেনা। পুজো এলেই ওদের মন ছটফট করে। দূরত্বের কারণে দেশে আসা যায়না। বিকল্পের খোঁজে বছর আটেক আগে এখানকার বাঙালি পরিবারের যৌথ উদ্যোগে শুরু হয় দুর্গাপুজো। প্রবাসে হলেও পুজোর আয়োজনের কোনো ঘাটতি থাকেনা। সুন্দর করে সাজানো হয় মণ্ডপ। প্রবল উৎসাহে তাতে প্রত্যেকেই হাত লাগায়। চরম ব্যস্ততার জন্য এখানে পুজো হয় দু’দিন। প্রথম দিন হয় সপ্তমী ও অষ্টমীর পুজো। পুরোহিতের উপস্থিতিতে আনা হয় ঘট। একেবারে রীতি মেনে পুজো হয়। পরের দিন হয় নবমী ও দশমীর পুজো। পুজোর সময় কলকাতা থেকে কোনো সঙ্গীত শিল্পী ওখানে যান এবং প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গীতের মাধ্যমে আনন্দ দেন। তবে প্রথম দিনের অন্যতম আকর্ষণ থাকে ওখানে বসবাসরত প্রায় সাত শতাধিক বাঙালির তিন বেলা একসঙ্গে ভোজন। প্রবীণ থেকে শুরু করে নবীন, পুরুষ থেকে মহিলা প্রত্যেকে একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। বাজনার তালে তাদের ট্রাডিশনাল বাঙালি নৃত্য দেখার মত। মুহূর্তের মধ্যে দূর হয়ে যায় কর্মক্ষেত্রের পদমর্যাদা। নবমীর দিন মাতৃপুজোর সঙ্গে গ্রহরাজের পুজো বাধ্যতামূলক, পুরুষদের হাতে তৈরি ভোগ নিবেদন করা হয় দেবীকে- তিনশ বছর ধরে এই পরম্পরা মেনে চলছে মঙ্গলকোটের গণপুর গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবার। আন্তরিকতার মাধ্যমে ভট্টাচার্য বাড়ির সদস্যরা আপন করে ফেলেছে সমগ্র গ্রামবাসীদের। ফলে সমস্ত গ্রামবাসীর অংশগ্রহণে পারিবারিক পুজো সার্বজনীন রূপ ধারণ করে। এখানে দূর্গাপুজোয় নবমীর দিন দেবীকে দু’বার ভোগ নিবেদনের বিধি রয়েছে। সেই ভোগ তৈরি করার অধিকারী কেবলমাত্র পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই। সাধক রামচন্দ্র ন্যায়বাগীশের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ভট্টাচার্য বাড়ির দুর্গাপুজো। মাটির ঘরে ‘মা’ এলেও সেখানে বরাবরের মত ভক্তির কোনো অভাব ছিলনা, আজও নাই। আজও সপরিবারে ‘মা’ আসেন এক পাটাতে। শত পরিবর্তনের মধ্যেও মূর্তির মধ্যে আছে সাবেকিয়ানার ছাপ, যাকে দেখলেই ভক্তির ভাব আসে মনে। সূর্য ওঠার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এখানে ঘট আনা হয়। একটা সময় সপ্তমী পুজোর দিন মায়ের ভোগ খাওয়ার জন্য বহু মানুষের সঙ্গে কয়েকজন ‘ফকির’-কে পুজোর ভোগ খেতে দ্যাখা যেত। ফলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিদর্শন ফুটে উঠত। এখানে বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। অষ্টমীর সন্ধিক্ষণে চালকুমড়ো বলি হয়। তখন কার্যত গোটা গ্রাম ভিড় জমায় পুজো প্রাঙ্গনে। সত্যিই এক দেখার মত দৃশ্য। এখানে বলির পর ঢোল বাদকদের ইঙ্গিত পাওয়ার পর আশেপাশের গ্রামে বলি হয় । নবমী পুজোর দিন মাতৃপুজোর সঙ্গে সঙ্গে গ্রহরাজেরও পুজো হয়। শোনা যায় স্বয়ং গ্রহরাজ নাকি সাধক রামচন্দ্র ন্যায়বাগীশকে এই নির্দেশ দিয়ে যান। আজও এই বংশের বংশধররা সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে। দশমীর দিনের অন্যতম আকর্ষণ সিঁদুর খেলা। ঘট বিসর্জনের আগে বিবাহিতা থেকে অবিবাহিতা প্রত্যেকেই মেতে ওঠে সিঁদুর খেলায়। দোল উৎসবকেও ছাড়িয়ে যায় সিঁদুর খেলার দৃশ্য । এখানে ভট্টাচার্য পরিবারের সদস্যরাই পুজো করে। নবমীর দিন তালপাতায় লেখা মন্ত্র আজও পাঠ করা হয়। এখানে প্রতিদিন নানা ব্যঞ্জন সহকারে দু’বার করে ভোগ হয়।

কর্মসূত্রে ভট্টাচার্য পরিবারের অনেকেই বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও পুজোর সময় প্রত্যেকেই গ্রামে ফিরে আসে। অন্য সময় ভট্টাচার্য পাড়া ফাঁকা থাকলেও পুজোর সময় জমজমাট হয়ে ওঠে। এইভাবেই পৃথিবীর সর্বত্রই বাঙালিরা মেতে ওঠে দুর্গাপুজোয়। তাদের আনন্দ বিস্মিত করে তোলে সমগ্র বিশ্ববাসীকে। ইউনেস্কো পর্যন্ত দুর্গাপুজোকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। যতদিন এই পৃথিবীতে বাঙালির অস্তিত্ব থাকবে ততদিন অন্য ধরনের আনন্দের সাক্ষী থাকার সুযোগ পাবে বিশ্ববাসী।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus (0 )