পরিযায়ী
সঙ্গীতা কর (কলকাতা)

প্রত্যেকবার পুজো এলেই মেয়েটা অপেক্ষা করে
একটা নতুন জামার জন্য
বছরে একবারই একটা নতুন জামা
তারপর সেটা টিনের বাক্সে তুলে রেখে
অনুষ্ঠান বাড়ি, নেমন্তন্ন বাড়ি, আত্মীয় বাড়ি যেতে
তার যে কি আনন্দ!
এবার সে বড় মুখ করে বলেছে
বাবা একগোছা কাঁচের চুড়ি এনো
এই শ্রাবণ মাসে সবাই পড়েছে
আমারও ভীষণ ইচ্ছা করছে
পাশ থেকে ওর মা ধমক দিয়ে বলে
এই চুপ কর
পেটের ভাত জোটে না ঠিকমতো তাদের আবার চুড়ি কি হবে?
মেয়েটা কাঁদে
তার কান্না পৌঁছে যায় অপর প্রান্তে
সামান্য কিপ্যাড ফোন, ভিডিও কল হয় না
দুই প্রান্তের মুখ দেখা হয় না কতদিন
ফোনের লাইনটা আচমকা কেটে যায়,
পুনরায় কল করার চেষ্টায় কানে বাজে ‘আপনি যে নাম্বারে কল করছেন সেটি এখন নেটওয়ার্কের বাইরে’
ক্লান্ত বাবা তখন শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন আঁকে
সেই ছোট্ট মেয়েটা বায়না করতে শিখেছে
কতদিন আগে দেখে এসেছে সে মুখ
উঠানে হামা দিতে দিতে এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে ঘুরে বেড়ানো
গায়ে ধুলো মাখা
আধো আধো উচ্চারণে বাব্বা বাব্বা বলা মেয়েটা আজ বায়না শিখেছে
এখন সে মায়ের কাছে বসে ‘কাবুলিওয়ালা’র গল্প শোনে
বড্ড ইচ্ছে করে তাকে দেখতে
সামনে এসে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুবেলা দু’মুঠো ভাত, মায়ের জন্য দুটো সাদা থানের শাড়ি, বউয়ের জন্য দুটো এগারো হাতের সুতির শাড়ি, আর মেয়েটার পরনের সাধারণ জামা!
ভাবতে ভাবতে চোখে তন্দ্রা আসে
সারাদিনের পরিশ্রম শেষে মানুষটি ঘুমিয়ে পড়ে
গভীর ঘুমে পিঠের আঘাতকে ইঁদুর, বিড়ালের দাপাদাপি ভেবে পাশ ফিরতেই
আবার আঘাত
যন্ত্রণায় মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ও মা!
কষ্ট পেয়ে ভুলে যায় সে ভিন রাজ্যের বাসিন্দা
এখানে তার মায়ের ভাষায় কথা বলা নিষেধ
এর পরের লাঠি পরে জেলখানার অন্ধকারে
বাইরে তখন বাতাসে ভাসে কয়েকটি প্রাণের উৎকণ্ঠা
মাঝখানের নিস্তব্ধতা ভেদ করে আবারও ফোন বাজে–
নিরুত্তর বাবা গরাদের ফাঁক থেকে উঁকি মেরে দেখে এক চিলতে আকাশ
সবার মাথার উপরে একই ছাদ
মেয়েটি তার মাকে প্রশ্ন করে
”মা-বাবাও কি ওই ‘কাবুলিওয়ালা’র মতো হয়ে গেল?”
এতক্ষণে পাঁচ মিনিটের চিত্রনাট্য সমাপ্ত হলো
দর্শকেরা ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেললো
প্রতিটি শ্বাস ছড়িয়ে গেল আকাশে—
ঠিক কতদূর তা কেউ জানেনা।