স্বপ্নের জাল বুনা
অনন্যা হালদার (মুকুন্দপুর, কলকাতা)

বিয়ের সাতদিন পরেই আয়ত্রীকে রেখে চাকরির সুবাদে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছিল রণধীর। আজ একবছর পর সে দেশে আসবে শুনে আয়ত্রীর মন খুশিতে উতলা হয়ে আছে, যদিও অনেকটা অভিমান জমেছিল তার মনের আকাশে। তবুও প্রতিদিনের মতো সকালে স্নান সেরে হলুদ-জামদানি আর ভারী গয়না পরেছে সে।
আয়ত্রীর অভিমান শুধু রণধীরের উপরেই নয় বরং কিছুটা তার নিজের বাবা-মায়ের উপরেও ছিল, কারণ রণধীরের ঠাকুরদা' ক্যান্সারের পেসেন্ট ছিল, তার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য ইমারজেন্সি ভিসা নিয়ে দু'সপ্তাহের জন্য দেশে এসেছিলেন রণধীর। তার মধ্যেই কনে দেখা থেকে শুরু করে গায়েহলুদ, বিয়ে, বৌভাত, অবশেষে ঠাকুরদার পরলোক গমন। সবকিছু মিলে ঠিকভাবে দু'টো কথাও হয়নি রণধীরের সাথে। তাই জন্য গত এক-বছরে বাবা-মায়ের অনেক পীড়াপীড়ির পরেও আয়ত্রী তার বাবার বাড়িতে যায়নি। স্বামী-রণধীরের সাথে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ফোনেও কথা বলেনি সে।
তবে এ' নিয়ে তেমন কোনো অভিযোগ নেই রণধীরের, বরং নিজের ভুলের জন্য সে অনুতপ্ত। তাই স্ত্রীর মান ভাঙাতে এক মাসের ছুটি নিয়ে দেশে ফিরেছে আজ। আয়ত্রীর জন্য একটা সারপ্রাইজ-ও রেডি করে রেখেছে মনে মনে।
আয়ত্রীর মা-বাবা রণধীরকে খুব ভালোবাসে, আয়ত্রীর সাথে রণধীরের যোগাযোগ কম হলেও তার বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। তাদের কাছ থেকেই রণধীর জেনে নিয়েছিল আয়ত্রীর পছন্দ-অপছন্দের কথা। তাই দেশে ফেরার আগেই আয়ত্রীর পছন্দের অনেক কিছু কিনে নেয় রণধীর, সাথে কাশ্মীর ভ্রমণের দু'টো টিকিট। কারণ কাশ্মীর ভ্রমণটা ছিল আয়ত্রীর সারাজীবনের শখ এবং স্বপ্ন।
বেলা বাড়ছে, কাঙ্ক্ষিত সময় পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘর ছুঁয়েছে, ইতোমধ্যে রণধীর বাড়িতে এসে হাজির। আয়ত্রীর ঘরে ঢুকে কোনো কথা না বলেই দু'হাতে আড় করে আয়ত্রীকে খাটে তুলে নিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো, এয়ারপোর্ট গেলে না কেন? আয়ত্রী অনেকটা অভিমান একত্রিত করে বললো, সবাই গিয়েছিল তো! আমার যেতে হবে কেন? এতটুকু বলেই পালালো সে।
দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেল, খাবার টেবিলে ব্যস্ত সবাই। আত্মীয়-স্বজন একসঙ্গে বসে হৈ-হুল্লর করে কেটে গেল অনেকটা সময়। রাত দশ'টায় কাশ্মীরে যাওয়ার ফ্লাইট। এক্ষুনি বেরুতে হবে তাদের। এটাই আয়ত্রীর প্রথম ফ্লাইটে ওঠা। যদিও একটু ভয় ভয় করছে তবুও রণধীরকে কিছুই বলছে না সে। বিয়ের বয়স এক বছর হলেও এটাই মনে হচ্ছে ওদের প্রথম দেখা। রণধীর আয়ত্রীর হাতটা টেনে থাইয়ের উপর রেখে আঙুলগুলোর ফাকে নিজের আঙুলগুলো বসিয়ে মুঠো করে বললো, আমাকে ক্ষমা করা যায় না? এখনো আমার সাথে রাগ করেই থাকবে?
একটু একটু করে অভিমানের সুতো কাটতে থাকে। এত দিনের জমিয়ে রাখা না-বলা কথাগুলো বলতে থাকে একে-অপর'কে। এভাবে করেই কেটে যায় বেশ কয়েক-ঘন্টা। কখন যে রনধীরের কাঁধে ঘুমিয়ে পরে আয়ত্রী, সেটা নিজেও জানে না।
খুব সকালে কাশ্মীরে পৌঁছে 'দ্য কটেজ নিগেন' গেস্ট-হাউসে ওঠে দু'জন। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে কিছুটা সময় বিশ্রাম করে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ে কাশ্মীরের সব থেকে সুন্দরতম স্থান পেহেলগাঁও দেখার জন্য।
ধূসর পাহাড়ের মনলোভা সাজ, ঝর্ণার কলকল ধ্বনি, অপরূপ সৌন্দর্যে ঘেরা পাইন গাছের বন, পাশেই সবুজ ঘাসের প্রাণজুরানো গালিচা। যেন ওদেরকে কাছে ডাকছিল। সবুজ ঘাসের উপর হেঁটে-হেঁটে দু'জন স্বপ্নের জাল বুনেছিল চোখে। একে অপরের হাত ধরে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল, সারাজীবন একসাথে থাকার।
স্বপ্নের উপত্যকায় হেঁটে হেঁটে গিয়েছিল বহু দুর। হঠাৎ নৈঃশব্দে ছেয়ে গেল পেহেলগাঁও। আয়ত্রীর চোখের সামনেই জঙ্গীরা কেড়ে নিল রণধীরের প্রাণ।
নিমিষেই রক্তাক্ত হলো সবুজ গালিচা।
নীরব হয়ে গেল আয়ত্রী। হাজার-হাজার প্রশ্ন ছুঁড়েছিল আয়েত্রীর নীরবতা। স্তব্ধ শীতলতার হাড় হিম আবহে ছেয়ে গেল ভারত-মাতা।
রণধীরের সাথে বাড়ি ফেরা হলো না আয়ত্রীর, হলো না আর স্বপ্নের জাল বুনা। মুছে গেলে আয়ত্রীর সীঁথির সিঁদূর। ঘোর অন্ধকারে ছেয়ে গেল আয়ত্রীর জীবন।
CATEGORIES কবিতা

