এই বৃষ্টি এই রোদ্দুর চিলেকোঠা
লিপিমিতা তনুশ্রী (কলকাতা)

মায়াময় রূপকথারা জড়িয়ে ধরে অনুক্ষণ
একান্ত যাপন চিলেকোঠার ঘরে ক্ষণিক তরে
বিশ্রাম অবকাশ না কৌতূহল, না-কি নিঃসঙ্গ পরবাস!
কত জনমের স্মৃতিধুলো ছাপ পিয়ানো সারেঙ্গীতে
হাতের স্পর্শ, সুরের মূর্চ্ছনা আজ অতীত ক্যানভাসে
ভৈরবী, বিলাবল, মেঘমল্লারে — বৃষ্টি নামে!
পুরনো আসবাবপত্রের মাঝে জেগে রয় প্রাচীন বৈভব
কাঠের চেয়ার-টেবিল, সিংহ-মুখ দেয়াল-আলমারি
সেগুন না মেহগনি জানিনা, জানি না কত বর্ষবলয় চিহ্ন
আঁকা আছে সেইসব সাবেকী সম্ভারে প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনে ;
শুধু জানি পিতামহ, প্রপিতামহ অথবা তারও আগের
পূর্বপুরুষের স্মৃতিময় হাতছানি, স্নেহ-মায়া-ঘ্রাণ
লেপে আছে পরতে পরতে অদৃশ্য অনুভবে ;
রঙচটা ফুলদানি, দোয়াত-কালি, ধুলোর আস্তরণ
মলিন করেছে আপামর পিতলের সুদৃশ্য শৌখিন বস্তু সব।
চেয়ার-হাতলে ছাপ নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস নির্যাসে ব্যাকুল নয়নে
অধর-ওষ্ঠে হাজারো প্রশ্ন উৎস খোঁজে, ঘুরপাক খায় চারপাশ —
কোনো এক অচিনপুরে অনির্দেশ্য অভিযান
মন ও মগজের ভিতর অবিরাম স্রোত প্রবহমান।
কত যুগ হেঁটে যাই— পুরনো শহর-নগর, অলিগলি পথ,
পথ বেয়ে চলে গেছে কোন সে সুদূর রূপকথা বন্দর
বন্দর অন্তর আসা-যাওয়া কোলাহল আপামর বিস্ময়
স্তম্ভিত, বিস্মৃত, ফেলে যাওয়া, ছুঁয়ে যাওয়া অজস্র নোনাজল ;
জলের ভিতর শতসহস্র শব্দের বুদবুদ ধুকপুক স্পন্দন শিহরণ
কবে যে মিলিয়ে গেছে বহু ক্রোশ পেরিয়ে আলোকবর্ষ দূরে
তবু কিছু পরমায়ু থেকে গেছে চেয়ার-টেবিলে কলমদানিতে।
চন্দন শরীরের ঘ্রাণ আজ ম্রিয়মান দীর্ঘ প্রতীক্ষাতে অনন্ত যাপনে
একরাশ হাহাকার কলম-তুলিতে, ভূর্জপত্রে, জীর্ণ চিঠিতে —
কালের হিসাব নেই কত কাল পেরিয়েছে আঙুলের স্পর্শ
নেই ভাবনার দোলাচল সৃষ্টির দ্যোতনা আজ রুদ্ধ পরিসর
শুধু ডায়েরির ভাঁজে ভাঁজে ধূসরতা প্রেম ঢাকে আপাদমস্তক
জলছবি আঁকিবুঁকি মেহনতী মানুষের কত-শত রূপ
বুকের আগলে শিকড় আঁকড়ে রেখেছে কিছু শব্দকল্পদ্রুম
সময়ের হিসাব-নিকাশ, ইতিহাস-পরিচয়, অমূল্য সম্ভার—
বাকি সব পড়ে থাকা মোহ-মায়া ছায়া-কায়া নিঃসীম শূণ্যতা
পাক খায় আবহমান, জীবনের সংযোগে জীবন যে বহমান
নীরবতা ততোধিক — সভ্যতা গতিপথ বয়ে চলে ঋণ।
চোখ বুজে কান পাতি গহীন অরণ্যে হৃদয় প্রান্তরে
বিপন্ন শতাব্দী প্রজন্মের হাত ধরে অতলান্ত অনুভবে—
সোঁদা-গন্ধ চারিদিক ভিজে আস্তরণ, মায়ামৃগ সংসার
না-কি শৈবালদামে সময়ের প্রলেপ যুগ-যুগান্তর!
বাইরে তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি জলোচ্ছ্বাস —
কার্নিশে ভেজা কাক ডাকছে অবিরাম ;
অসহায়তা না নিঃসঙ্গতা কে জানে—
তবে কি একান্তে আজ এসেছে ফিরে চিলেকোঠার ঘরে
সোনার-কাঠি রূপোর-কাঠি সভ্যতা সংগ্রামে!
তখন শুধু অন্বেষণে, তখন আমি আপনমনে
ভিজছি শুধু রোদ-বৃষ্টি গায়ে মেখে বিহ্বল আবেশে।।

