আজও অভিনবত্বের দাবি রাখে আউসগ্রামের দুর্গাপুজো

আজও অভিনবত্বের দাবি রাখে আউসগ্রামের দুর্গাপুজো

জ্যোতি প্রকাশ মুখার্জ্জী: পূর্ব বর্ধমান:-

        যেকোনো উৎসবে, এমনকি রাজনৈতিক জনসভায়, ভিড় টানার লক্ষ্যে উদ্যোক্তাদের একাংশ রঙিন গ্ল্যামার জগত অথবা অন্য কোনো জনপ্রিয় মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উপর নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে দুর্গাপুজোয় আজও প্রকৃত অর্থে অভিনবত্বের দাবি রাখে আউশগ্রামের গোপালপুর উল্লাসপুর গ্রামের দুর্গাপুজো কমিটি। জনপ্রিয় মুখের পরিবর্তে তারা দুর্গাপুজোর আগে কখনো কৃষক, শ্রমজীবী, সমাজের চোখে ঘৃণিতা পতিতা বা বৃহন্নলাদের মত মাটির সঙ্গে সম্পর্কিত সাধারণ মানুষদের এনে দেবতা জ্ঞানে পুজো করেন। দুর্গাপুজোর মত বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবে যেখানে লক্ষ লক্ষ বাঙালির আবেগ জড়িয়ে আছে সেখানে এইসব সাধারণ মানুষের পুজো করা পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই যেমন অভিনব তেমনি যথেষ্ট বিতর্কিত।   

        একসময় আউশগ্রামের জঙ্গলমহলের আদিবাসী অধ্যুষিত গোপালপুর উল্লাসপুর গ্রামে হতোনা দুর্গাপুজো। বাসিন্দাদের অধিকাংশ পেশায় ক্ষেতমজুর। আর্থিক কারণে তাদের পক্ষে দুর্গাপুজোর মত ব্যয়বহুল পুজোর আয়োজন করা সম্ভব ছিলনা। মনের মধ্যে থেকে গিয়েছিল গভীর আক্ষেপ। সেই আক্ষেপ দূর করতে এগিয়ে আসেন গ্রামের বাসিন্দা বিশিষ্ট সাহিত্যিক তথা গবেষক রাধামাধব মণ্ডল। তিনিও সাধারণ কৃষক  ও ক্ষেতমজুর পরিবারের সন্তান। 

        ছোট থেকেই রাধামাধব দেখেছেন নিজের গ্রামে কোনো দুর্গাপুজো নেই। পাশের গ্রামে জমিদার বাড়িতে দুর্গাপুজো দেখতে গিয়ে পাড়ার মানুষগুলোকে অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পায়নি পুজোর ‘প্রসাদ’। বিষণ্ন মুখে তারা নিজের গ্রামে ফিরে আসে। পুজোর সময় এই করুণ দৃশ্য রাধামাধবের  বুকের মধ্যে যন্ত্রণার পাহাড় হয়ে দাঁড়ায়। সেই কষ্ট দূর করার জন্য গ্রামের মহিলা ও ক্ষেতমজুরদের সঙ্গে নিয়ে নিজের গ্রামে খুবই সাদামাটা ভাবে শুরু করেন দুর্গাপুজো। গ্রামের মধ্যে বয়ে যায় খুশির হাওয়া। নবীন থেকে শুরু করে প্রবীণ – সবাই মেতে ওঠে দুর্গাপুজোর আনন্দে। সবার মিলিত খুশিতে অকাল বসন্ত নেমে আসে গ্রামে।

       পুজো পরিচালনা করার জন্য গ্রামের মহিলাদের নিয়ে গড়ে ওঠে ‘পুজো পরিচালন কমিটি’। প্রবল উৎসাহে রাখী, তুলিকা, মিতালী, বন্দনা, টুম্পা, সন্ধ্যা প্রমুখরা পুজো পরিচালানা করেন। পাশে পান পুরুষদের। পুজোয় থাকে ভিন্ন স্বাদের ‘থিম’ এর ছোঁয়া। জানা যাচ্ছে এবার   পুজোর থিম হচ্ছে ‘বাংলার বইগ্রাম’। বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে সাজানো শুরু হচ্ছে পুজোর প্যাণ্ডেল, মণ্ডপ। প্রতিমাতেও থাকছে অভিনবত্বের ছোঁয়া।

      অতীতের মত এবারও পুজোর উদ্বোধন হবে চতুর্থীর দিন। সেদিন থেকেই বাংলার নানান লোকসংস্কৃতির অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। নাটক করবে গ্রামের মেয়েরা। এছাড়াও পুজোতে  আউশগ্রামের ঐতিহ্য, বাংলা ও বাঙালির গর্বের পাণ্ডুরাজার ঢিবিকে তুলে ধরা হবে। পুজোর সময়   এবারও সাহিত্যের ‘সহজ’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশিত হবে। রাজ্যের প্রথম সারির বহু লেখক সেই পত্রিকায় কলম ধরেন। 

        অজয় দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। নদীর বাঁধ ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে গ্রাম। পারিপার্শ্বিক অনেক পরিবর্তনের মধ্যেও আজও পুজোর সময় গ্রামটি ধরে রেখেছে তাদের অতীত ঐতিহ্য। শহর থেকে অনেক জনপ্রিয় মানুষ এলেও পুজোর আগে আজও সাধারণ মানুষের পুজো করা হয়। সবার বিশ্বাস পরবর্তী প্রজন্ম দুর্গাপুজোর সময় গ্রামের প্রচলিত ঐতিহ্য ধরে রাখবে। কথা বলতে বলতে নস্টালজিক রাধামাধব আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। দেখতে থাকেন পুজো মণ্ডপ তৈরি।

CATEGORIES

COMMENTS

Wordpress (0)
Disqus ( )